
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দুই বছর ধরে মানুষ মাস্ক-গ্লাভসসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করছেন। ব্যবহৃত এসব সামগ্রী অনেকে যেখানে-সেখানে ফেলে দেন। এগুলো জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। নাগরিক শিষ্টাচার না মেনে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া এসব সামগ্রী এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশানো এসব সুরক্ষাসামগ্রী জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, এ বিষয়ে ‘জনসচেতনতা’ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্যবহৃত মাস্ক-গ্লাভস নিয়ে উদাসীনতার চরম মূল্য দিতে হবে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একশ্রেণির অসচেতন মানুষ ব্যবহারের পর যেখানে খুশি সেখানেই ফেলছেন মাস্ক, গ্লাভস। নগরীর প্রতিটি গলি, সড়ক, ড্রেন, ফুটপাত সবখানেই ব্যবহৃত মাস্কের ছড়াছড়ি। পড়ে থাকা গ্লাভস ও আই-প্রোটেকশন গ্লাভসের তুলনায় সাদা বা নীল রঙের সার্জিক্যাল মাস্কের পরিমাণই বেশি। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের অভাবকে দুষছে নগরবাসী। তবে সরেজমিনে ঘুরে অসেচতনতা এবং আইনের প্রয়োগে উদাসীনতাই চোখে পড়েছে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেলে দেওয়া এসব সুরক্ষাসামগ্রী করোনা ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। এ ছাড়া যেখানে-সেখানে ফেলা মাস্ক হতে পারে নানাবিধ রোগের কারণ। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত বা উপসর্গহীন মানুষ যেসব মাস্ক ব্যবহার করে; সেগুলো করোনাভাইরাস ছড়ানোর একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। এসব মাস্ক কিংবা গ্লাভস যেখানে-সেখানে ফেলা যাবে না। এ বিষয়টি মানুষকে বোঝাতে হবে। কোভিড-১৯ রোগী অথবা সন্দেহজনক কোভিড-১৯ রোগীর ব্যবহৃত মাস্কের মাধ্যমে ভাইরাস দ্রুত ছড়াতে পারে। এগুলো অন্যান্য রোগ ছড়ানোরও উপকরণ।
রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় রাস্তায় পড়ে থাকা মাস্ক দেখিয়ে বেসরকারি চাকরিজীবী রাসেল বলেন, ‘ডাস্টবিনে যে ময়লা ফেলতে হবে এই সংস্কৃতি আমাদের গড়ে উঠেনি। রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা ফেলা আমাদের এখানে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এজন্য কারো কোনো শাস্তি হয় না।’ রিকশাচালক হাশেম আলী বলেন, ‘এখন রাস্তায় গাছের পাতার চেয়ে মাস্ক বেশি। সবাই তো এখন মাস্ক ব্যবহার করে। রাস্তায় মাস্ক তো থাকবেই।’
করোনা সংক্রমণ বাড়লে সরকারি অফিস-আদালত এবং জনসমাগম হয় এমন সব জায়গায় মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে মাস্ক ব্যবহার-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, শপিং মল, হাটবাজার, গণপরিবহন, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হোটেল- রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে সবাইকে এই নির্দেশনা মানতে বলা হয়। এ ছাড়া বাড়িতে করোনা উপসর্গের কোনো রোগী থাকলে পরিবারের সুস্থ সদস্যদেরও মাস্ক ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে মাস্ক ব্যবহারের পরে সেগুলো কী করতে হবে, সে সম্পর্কিত কোনো কিছুই এ নির্দেশনায় বলা হয়নি।
পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, যততত্র ফেলে দেওয়া এ ধরনের বর্জ্য মানুষ ছাড়া পরিবেশ ও প্রাণিকুলের জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা বুড়িগঙ্গা নদীতে একটা সার্ভে করেছি। সেখানে নদীগর্ভে প্রচুর মাস্ক এবং গ্লাভস পেয়েছি। এ ছাড়া কিছু মাস্ক ভাসছে, আবার দুই কূলেও প্রচুর মাস্ক, গ্লাভস পেয়েছি।’
তিনি বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ মাস্ক সিনথেটিক থেকে তৈরি। এক ধরনের পলি কেমিক্যাল থেকে এগুলো তৈরি হয়। এই পলি কেমিক্যাল থেকে কিন্তু পলিথিনও তৈরি হয়। বাজারের সার্জিক্যাল মাস্কগুলো এখন টিস্যু পলিব্যাগের উন্নত ভার্সন। পলিথিনের মতোই এগুলো সহজে গলবে না বা নষ্ট হবে না।
দীর্ঘদিন মাটিতে থাকা এই বর্জ্য ড্রেনেজ সিস্টেম জ্যাম করে ওয়াটার লগিং, মাটির উর্বরতা কমানোসহ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অনেক ক্ষতি করতে পারে।
এদিকে মাস্ক নিয়ে যখন এমন খামখেয়ালি চলছে, তখন নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে মাইকিং ও গণসংযোগে ব্যস্ত দুই সিটি করপোরেশন। গৃহস্থালি বর্জ্যরে সঙ্গে মেডিকেল বর্জ্য আসায় সেগুলো আলাদা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।
এ নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন বলেন, ‘এই বর্জ্যগুলো আমরা কালেক্ট করার চেষ্টা করছি। মানুষকে যত্রতত্র মাস্ক ফেলতে নিষেধ করছি। আমাদের প্রচার অব্যাহত আছে। আমরা মাইকিং করছি, সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছি যেন মাস্ক কিংবা গ্লাভস তারা জায়গামতো ফেলেন। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ বর্জ্য আর মেডিকেল বর্জ্য এখন একসঙ্গে আসছে। এগুলো আলাদা করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটে যারা ফেলছে, তারা তো ফেলছেই।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর এম সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই এগুলো কালেকশন করার চেষ্টা করছি। কোভিড-১৯ সুরক্ষায় ব্যবহৃত জিনিসগুলো আমরা আলাদা করে প্রিজমকে দিয়ে দিচ্ছি। কোনো কোনো এলাকায় এ ধরনের আবর্জনা থাকতে পারে। সেগুলো অপসারণে আমরা কাজ করছি।’
Leave a Reply