হাসিনার সহযোগী তিন ঠিকাদার বশীর-রব্বানী-শরীফ এখন পাউবোর নিয়ন্ত্রক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ  ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলমের প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে বিগত ১৫ বছরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাগিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক ব্যবস্থাপনা পরিচালাক (এমডি) বশীর আহমেদ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০০৯ সাল-পরবর্তী সময় থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং দেড় শতাধিক ঠিকাদারি কাজ করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ কাজই ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগেই হয়েছে লুটপাট। এখনো ৫২টি কাজ চলমান রয়েছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের।

জানা যায়, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে বিভিন্ন কাজে প্রভাব বিস্তার করতেন বশির। বাগেরহাটের মোংলা বন্দর এলাকায় যৌথ মালিকানায় জমিও কিনেছেন। হানিফের মালিকানাধীন কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনালের ড্রেজার এখন ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হেফাজতে। বশির দেখভাল করছেন হানিফের সম্পদও। প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজও করেছেন। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ইকোনমিক জোন, রাজউক, সড়ক ও জনপথ, এলজিইডিসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজও বাগিয়েছেন তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পাউবোতে যতগুলো বড় প্রকল্প হয়েছে প্রায় সবগুলোতে ঠিকাদারি কাজ নিয়েছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। কেবল কাজ নেওয়াই নয়, বাকি কাজ বণ্টনের দায়িত্বও পালন করতেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদ। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ প্রতিষ্ঠানটির পার্টনার—এমন তথ্য দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন সর্বত্র। এ ছাড়া যখন যিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব হয়েছেন, সবার সঙ্গেই গড়ে তুলতেন সম্পর্ক। বিশেষ করে সাবেক পানি সচিব কবির বিন আনোয়ারের সময়কালে বিভিন্ন কাজ বাগাতেন লভ্যাংশ বণ্টনের বিনিময়ে। এ ছাড়া পাউবোর মহাপরিচালক, প্রধান প্রকৌশলীদের সঙ্গেও সদ্ভাব ছিল বশির আহমেদের।

বশির আহমেদের অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বশিরের বিরুদ্ধে ৫১ কোটি ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৩ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে।

তবে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, পালিয়েছেন স্বৈরাচারী হাসিনা কিন্তু অন্তবর্তী ড. অধ্যাপক ইউনুস সরকারের আমলেও সেই ফ্যাসিস্ট হাসিনার সিস্টেমেই কর্মকর্তার ম্যানেজ করে বর্তমান সব কাজই বাগিয়ে নিচ্ছেন তিনি।

 আরেক ঠিকাদার গোলাম রব্বানী কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রব্বানী কামনা

ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে হাজার কোটি টাকার পাউবোর কাজ বাগিয়ে নিয়ে নামে মাত্র কাজ করে লুটপাট করে খাওয়া আরেক ঠিকাদার গোলাম রব্বানী কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রব্বানী কামনা। আওয়ামী লীগে সমর্থক এবং ক্ষমতাধর ঠিকাদার হিসেবে পাউবোতে তিনি বেশ সুপরিচিত। পাবনা, সিরাজগঞ্জের পদ্মা ও যমুনা নদী কেন্দ্রিক এবং উত্তবঙ্গের বেশির ভাগ জেলার পাউবোর যত ঠিকাদারি কাজ তা সব বাগিয়েছেন এই ঠিকাদার। গড়েছেন শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট হাসিনা পতনের দুই মাস পর অর্থ্যাৎ ৫ অক্টোবর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে পাবনা জেলা জামায়াতে ইসলামীর আয়োজনে সুধী সমাবেশের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে নিজের গাড়িতে ঘুরিয়ে বেড়ান গোলাম রব্বানী কামনা। আওয়ামী লীগের এই ঠিকাদার কিভাবে জামায়াতের ঘারে চেপে বসলেন তা নিয়ে পাবনা জেলা জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ব্যাপক সমালোচনার ঝর উঠে।

বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলের আওয়ামী সমর্থিত ঠিকাদার হিসেবে পাওয়া পরিচয়  ঘুচতে জামায়াতের আমীরের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। সেই প্রভাবে বর্তমানে পাউবোর যত ঠিকাদারি আছে উত্তরাঞ্চলে প্রায় সব কাজগুলোই তিনি বাগিয়ে নিচ্ছেন। এছাড়া ৫ আগস্টের পরে গত ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং তারিখে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদার সমিতি’র সহ সভাপতি পদ বাগিয়ে নেন তিনি। পাঁচ আগস্টের আগে ছাত্র জনতার বিক্ষোভ দমাতে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। হাসিনার আমলে এবং ছাত্র জনতার গণঅভ্যত্থানে যত বিতর্কও থাকুক না কেন তিনি এখন পাউবোর অন্যতম প্রভাবশালী ঠিকাদার। এর পিছে রয়েছে যেমন জামায়াত তেমনি রয়েছে পাউবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাও।

পাউবোর আওয়ামী আমলের আরেক ক্ষমতাধর মেসার্স শরীফ এন্ড সন্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মনিরুজ্জামান শরীফ

মেসার্স শরীফ এন্ড সন্সের মালিক মনিরুজ্জামান শরীফ আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শেখসেলিম ও রাজউকের চাকুরীচ্যুত প্রধান প্রকোশলী উজ্জল মল্লিকের ব্যবসায়িক পার্টনার দীর্ঘ ১৭বছর সিন্ডকেট করে পাউবো, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, গণপূর্ত, রাজউক সহ অনান্য সরকারি কাজের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও লুটপাট করেছেন। বর্তমানে  হাসিনার পতনের পরও সিন্ডিকেট করে এবং পাউবো কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শত কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। পাউবোতে তার প্রভাবের কোন অংশের কমতি নেই।

এ বিষয়ে পাউবোর একাধিক ঠিকাদার জানান, যারা হাসিনার দোসর, হাসিনার আমলে হাজার কোটি টাকা পাউবো থেকে লুটপাট করেছে এখন তারাই সক্রিয়। বর্তমান পাউবোর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এই তিন ঠিকাদার প্রায় ৯০ ভাগ কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। পাঁচ আগস্টের ছাত্রদের রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি অথচ পাঁচ আগস্ট হাসিনার পতন ঠেকাতে অর্থ ব্যয় করা এই তিন ঠিকাদার এখনও পাউবোর নিয়ন্ত্রক। বিষয় প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এই তিন ঠিকাদারসহ পাউবোর জড়িত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেন তিনি।

কীভাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগিরা এখনও পাউবোতে শক্তিশালী এবং অধিকাংশ কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন জানতে চেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) এ, কে, এম, তাহমিদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।