
আবারও মাঠে নেমেছে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের পর কিছুদিন বন্ধ থাকলেও এখন স্বর্ণ পাচার চলছে পুরোদমে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে পাচার হচ্ছে বেশির ভাগ স্বর্ণ। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে গত দুই দিনে পাচার হওয়া সাড়ে ১৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) যৌথভাবে। এ সময় আট চোরাকারবারিকে আটক করেছে তারা।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার এসব অভিযান চালানো হয়। ১৪ কেজির মধ্যে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা পার হয়ে ওপারে যায় প্রায় ৯ কেজি স্বর্ণ। গত রবিবার বাকি প্রায় পাঁচ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার হয় বাংলাদেশ সীমান্তে। এদিকে এমপি আনারের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মোটিভ ছিল স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে বিরোধ। এই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য দলীয় বিরোধকে কাজে লাগাচ্ছে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জড়িত মূল গডফাদাররা।
বিজিবির দেওয়া সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে বিএসএফের আট ব্যাটালিয়নের সদস্যরা পশ্চিমবঙ্গে নদিয়া জেলার পুট্টিখালীর সীমান্ত ফাঁড়ি এলাকার মথুরাপুর গ্রামে তল্লাশি চালান। এ সময় মথুর দাস নামে এক সন্দেহভাজনকে চ্যালেঞ্জ করে তল্লাশি করলে তার কাছ থেকে ২০টি স্বর্ণের বার ও দুটি স্বর্ণের ইট উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা স্বর্ণের ওজন প্রায় ৪ দশমিক ৭ কেজি। এর ভারতীয় বাজারমূল্য ৩ দশমিক ৩ কোটি রুপির বেশি। বিএসএফের দাবি, উদ্ধার করা স্বর্ণ বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। আটক মথুর দাস পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বাসিন্দা। জিজ্ঞাসাবাদে, মথুর স্বীকার করেছেন, স্বর্ণের চালানটি তিনি বনগাঁয় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন। দীর্ঘদিন এ কাজ করে ভালো অর্থ উপার্জন করেছেন বলেও জিজ্ঞসাবাদে স্বীকার করেছেন মথুর। আটক ব্যক্তি এবং উদ্ধার করা স্বর্ণের পরবর্তী আইনি ব্যবস্থার জন্য রাজস্ব গোয়েন্দা অধিদপ্তর (ডিআরআই) কলকাতার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মহেশপুর, জীবননগর, দর্শনা, চৌগাছা দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ গেটওয়ে হিসেবে পাচারকারীরা ব্যবহার করে আসছে।
২০২১ থেকে ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত মহেশপুরে স্বর্ণ চোরাচালানের মামলা হয়েছে ২৬টি। ঝিনাইদহ ট্রেজারিতে ৭০ কেজি ৩৯৯ গ্রামের বেশি স্বর্ণ জমা দেওয়া হয়েছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৭০ কোটি ৩৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা (প্রতি গ্রাম ১০ হাজার টাকা হিসাবে)। একই সময়ে পাশের জেলা চুয়াডাঙ্গার ট্রেজারিতেও বিপুল পরিমাণ উদ্ধার করা স্বর্ণ জমা পড়েছে। সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ ভারতে পাচার হয়েছে ২০২২ সালে। এ সময়ে বিগত দিনের রেকর্ড ভেঙে ৩৩ কেজি ১৮৯ গ্রামের বেশি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, যে পরিমাণ স্বর্ণ জব্দ করা হচ্ছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি ওপারে (ভারতে) পাচার হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স হিসেবে যারা কাজ করে, তারাও স্বর্ণ পাচার ও হুন্ডি সিন্ডিকেটের সদস্য। সীমান্ত এলাকায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য এক বছরেই শতকোটি টাকার মালিক হয়ে যায়। এমন তথ্যও সীমান্তবাসীদের মুখে মুখে এবং তারা তাদের চেনে।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানির সিন্ডিকেট খুবই শক্তিশালী। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের পর তারা কিছুদিন চুপ ছিল। আবার সক্রিয় হয়েছে চক্রটি। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলের এক শ্রেণির প্রভাবশালী নেতাদের অর্থ দেয় স্বর্ণ চোরাচালানের মাফিয়ারা। কখনো কখনো বিরোধী দলকেও টাকা দেয়, যাতে ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকা যায়। একসময় সিনেমা হলের টিকিট বিক্রি করত, স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসায় জড়িয়ে সেও এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক।
এদিকে আনার হত্যাকাণ্ড ভিন্ন খাতে নিতে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মাঠে নেমেছে। এতে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থার নিরসন ঘটাতে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে দুই গ্রুপের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ না হয়। ঝিনাইদহ-৪ আসনের একাধিক নেতা জানান, এরকম বহু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। কেউ সাক্ষী দিতে যাবে না প্রাণের ভয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটা পর্যায়ে চুপ হয়ে যাবে। কারণ এর পেছনে রয়েছে বড় আর্থিক লেনদেন। একেক গ্রুপের সঙ্গে প্রভাবশালী একাধিক নেতা জড়িত।
Leave a Reply