
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ভারতের উডিষ্যায় আঘাত হানলেও এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানিবন্দি থাকলেও বর্তমানে সুপেয় পানির সংকটে রয়েছেন উপকূলের অন্তত ছয় উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলজুড়ে নলকূপের পানি লোনা হয়ে গেছে। খাবার পানির ভরসা ছিল পুকুর। ইয়াসের প্রভাবে পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় তা এখন পানের উপযুক্ত নয়। বিভিন্ন সংস্থা খাদ্য সহায়তা দিলেও পানির সংকট তীব্র। ফিটকিরি দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা হলেও লবণাক্ততা যাচ্ছে না। দ্রুত খাবার পানির ব্যবস্থা না হলে দূষিত ও লোনাপানি পান করে অসুস্থতা বাড়তে পারে। একইভাবে সুন্দরবনের লবণাক্ত পানির প্রভাবে দেখা দিয়েছে পশুপাখির খাবার পানির সংকট।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরদার মোস্তফা শাহিন আমাদের সময়কে বলেন, পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য আমরা এখন পর্যন্ত ২০ হাজার ট্যাবলেট বিতরণ করেছি। আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো- যে পানি বিশুদ্ধ করা হবে, সেটিও অতিরিক্ত লবণাক্ত। আমরা বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য মোবাইল ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে পানির সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করব। ইতোমধ্যে যোগাযোগ করছি।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা রামপালসহ বিভিন্ন এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এমনিতেই খাবার পানির তীব্র সংকট ছিল, জোয়ারে লবণপানি আসায় তা আরও ঘনীভূত হয়েছে।
এদিকে সুন্দরবন লাগোয়া সাতক্ষীরার উপজেলা শ্যামনগর ও আশাশুনির উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো উপচে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকেছে। সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, স্বাভাবিক সময়েই উপকূলের মানুষ খাবার পানির সংকটে থাকেন। এসব এলাকার মানুষের ভরসা পুকুরের পানি। কিন্তু জোয়ারে পুকুরের পানিও লবণাক্ত হয়ে গেছে। দুর্গম এলাকা থেকে অনেকেই পানির জন্য অন্যত্র যেতে পারছেন না।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আ ন ম আবুজর গিফারী বলেন, এক লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। আরও করা হবে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে, লবণাক্ত পানিতে সুন্দরবনের অনেক রকম ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বন কর্তৃপক্ষ। লবণাক্ত পানির প্রভাবে দেখা দিয়েছে পশুপাখির খাবার পানির সংকট। তবে বন্যপ্রাণীরা উঁচু স্থানে আশ্রয় নেওয়ায় তাদের মৃত্যু কম হয়েছে বলে বনকর্মীদের ধারণা। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসীন হোসেন বলেন, বনের পশ্চিম অংশে ৫৪টি পুকুরের মধ্যে ৫৩টিতে লোনাপানি ঢুকেছে। এতে পশুপাখির সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে। বনের মধ্যে কর্মরত বনকর্মী, জেলে ও বাওয়ালি ছাড়াও পশুপাখি এসব পুকুর থেকে পানি পান করে থাকে। তিনি বলেন, পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু জোয়ারে বেশ কিছু জলযান, ওয়াচ টাওয়ার, গোলঘর ও ফুটরেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত চারটি হরিণ জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা গেছে। ১২টি কাঠের জেটি, কয়রা ও বজবজিয়ায় ৩৫টি ফাঁড়ি ও স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভারী বৃষ্টি, জোয়ার ও পানি বৃদ্ধির কারণে পূর্ব সুন্দরবনের ১৯টি জেটি, ছয়টি ট্রলার, দুটি গোলঘর, একটি ফুটরেল, একটি ওয়াচ টাওয়ার, চারটি স্টাফ ব্যারাক, একটি রেস্ট হাউস ও দুটি অফিসের রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। ৯টি মিঠাপানির পুকুরে লবণাক্ত পানি ঢুকেছে। করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে জলোচ্ছ্বাসে ও বাতাসে দুটি কুমিরের শেড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানির স্তর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রের প্রাণীগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ায় তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
উপকূলীয় ১৩ জেলার মৎস্য খাতের ২০২ কোটি ১৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের বিবরণে বলা হয়েছে, দেশের উপকূলীয় ১৩ জেলার ৬৯ উপজেলার ৪০৭টি ইউনিয়নে ২০২ কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে ২০ হাজার ১৪৮টি পুকুর, দীঘি ও খামার; যার আয়তন প্রায় দুই হাজার ৮৩১ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২১ হাজার ৭৩৫টি ঘের, যার আয়তন ২০ হাজার ৭১ হেক্টর। মাছের ক্ষতি হিসেবে বলা হয়েছে- ফিন ফিশ ৩ হাজার ৮০৩ টন, ১ হাজার ৯৪৬ টন চিংড়ি, ২৫১ লাখ পোনা, মাছ ৫ হাজার ৫৪৫.১৪ (লাখ) টাকা, ১০ হাজার ১৭২.৫৬ (লাখ) চিংড়ি, পোনা ৬৩২.৯৪ (লাখ) টাকা এবং পিএল ৫০০.৬৮ (লাখ) টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে মারা গেছেন একজন। অন্যদিকে আহত হয়েছে ২০ জন জেলে।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বলেন, সারাদেশের মৎস্য সেক্টরের ক্ষতির হিসাব মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ১০ হাজার টাকা থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত সহায়তা দিয়েছি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
Leave a Reply