মুখরতায় আ.লীগ, শূন্যতায় বিএনপি

সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সরকারি দল আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, তাদের সামনে এখন চারটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলটির নেতারা বলছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। বিদেশি চাপের কারণে নতুন কোনো সংকটের মুখোমুখি না পড়া, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা ও ছোট-বড় যত বেশি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনা এবং বিদেশিদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বীকৃতি আদায় এগুলোই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, দেশ-বিদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যে অঙ্গীকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন, তা বাস্তবায়নের জায়গা থেকে তারা ওই বিষয়গুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। এ ছাড়া নির্বাচন পর্যন্ত চাপে পড়া অর্থনীতি সচল রাখাও আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে নেতারা মনে করছেন।

সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অনড়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ অবস্থায় গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এখন পর্যন্ত একজন পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। কর্মসূচিগুলো ঘিরে গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র শর্তহীন সংলাপের তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিলেও সমঝোতার পথ এখনো খোলেনি।

এ অবস্থায় গত বুধবার সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। আগামী ৭ জানুয়ারি ৩০০ আসনে ব্যালটে ভোট হবে।

তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই নির্বাচনের মাঠ গোছানোর কাজে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ। তফসিল ঘোষণার পর আরও জোরেশোরে মাঠে নেমে পড়েছে দলটি। নির্বাচন ঘিরে দেশি-বিদেশি চাপে পড়া আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে বলে দলটির নেতারা মনে করছেন।

তফসিল ঘোষণা করা হলেও বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন এখনো অব্যাহত রেখেছে। অবরোধ কর্মসূচির পর আগামী রবি-সোমবার হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি।

আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন, তারা বিএনপির আন্দোলনকে কোনোদিক থেকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন না। বিএনপি আন্দোলন করে নির্বাচন প্রতিহত করার সাংগঠনিক শক্তি রাখে না বলেও মনে করে টানা ১৫ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলটির নেতারা।

বিএনপি নির্বাচনে আসবে, এমন কানাঘুষা আওয়ামী লীগের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। তফসিল ঘোষণার পর এ কানাঘুষা আরও বেড়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা একটি চ্যালেঞ্জ। কোনো কোনো মহলে আলেচনা আছে নির্বাচনে আসার সুযোগ না দেওয়াও আরেক ধরনের চ্যালেঞ্জ। তারা বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে ধরে নিলেও আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি আরও দুই-তিনগুণ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে দলের যারা মনে করেন বিএনপি নির্বাচনে না এলেও এখন যে জটিলতা আছে তা নিরসন করা যাবে। তাই বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে গুরুত্ব না দেওয়া বরং বেশি ভালো হবে। এটা আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গীরাও চায়। শরিক দলের নেতাদের ভাষ্য, বিএনপি নির্বাচনে এলে জোটের গুরুত্ব বাড়লেও জোটের প্রার্থীদের জয় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সরকারে থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠান সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, নির্বাচন ঘিরে দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। সেটি কাটিয়ে তুলে জনগণকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, ভোটকে উৎসবমুখর করে তোলা এগুলো এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ, এখনো পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক দল ভোট বর্জন ও প্রতিহত করার কথা বলে মাঠে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। শেষ পর্যন্ত ওই দলটি নির্বাচনের বাইরে থাকলে আশানুরূপ ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ সবসময়ই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে গেছে। আগামীতেও চ্যালেঞ্জ আসবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে। এর মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ নির্ধারণ করা লক্ষ্য পূরণ করবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ফারুক খানও বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই। আওয়ামী লীগ সবসময় স্রোতের উল্টোদিকে নৌকা বেয়ে চলা দল। সরকারে থেকে আওয়ামী লীগ করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলা করেছে। ২০১৩-১৪ সালে বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছে। অতীতে যেভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়েছে, ভবিষ্যতেও একইভাবে মোকাবিলা করবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে নেমে পড়েছি। নির্বাচনে কীভাবে দল জয়যুক্ত হবে সেই কর্মপদ্ধতি নিয়ে এগিয়ে চলেছি।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতিই আমাদের কাছে এখন বেশি গুরুত্বের।’ তিনি মনে করেন, নির্বাচনী জোয়ারে সব চ্যালেঞ্জ, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র বিলীন হয়ে যাবে।

কর্মীদের ধরে রেখে দাবি আদায়ের চেষ্টা বিএনপির

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার পর বিএনপির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনে

থাকলে দলটিকে বিজয়ী হতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, এ সিদ্ধান্তেও আসতে হবে বিএনপিকে।

এ ছাড়া দলে মোটা দাগে ভাঙন না ধরলেও মধ্য ও নিচের সারির নেতা এবং তৃণমূলের কর্মীদের ধরে রাখারও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আন্দোলন জোরদার করতে গ্রেপ্তার এড়িয়ে রাজপথে থাকাও দলটির জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক মহলে এবং দলের ভেতর এ বিষয় আলোচনা আছে। সে ক্ষেত্রে নতুন কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যায়, সেটাও ভাবছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ এবং পরবর্তী হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলো একই ধরনের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতার ঘটনাও আছে। পাশাপাশি ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী এখন কারাগারে।

তফসিল ঘোষণার আগে গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র নিঃশর্ত সংলাপ চেয়ে বিএনপিসহ তিন দলকে চিঠি দেয়। কিন্তু দলটি সমঝোতায় আসার বিষয়ে এখনো ইতিবাচক কিছু জানায়নি।

সম্প্রতি দলের বহিষ্কৃত ও বর্তমানে নেতাদের কয়েকজন নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে নতুন দলের যোগ দিয়েছেন, কিংবা নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠন করছেন। যারা এ তৎপরতার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ভয় রয়েছে। কারণ বিএনপি নির্বাচনপন্থি দল হিসেবে নেতাকর্মীরা আশা করেন দল একদিন না একদিন ক্ষমতায় আসবে। তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় নেতাকর্মীদের মনোবলে চিড় ধরতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, দলটি জন্মলগ্ন থেকেই নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সামনে এগিয়েছে। আগামীতেও একইভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে।

গত বুধবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য খন্দকার আহসান হাবিবের নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছেন নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনের পর বিএনপি থেকে তাদের দুজনকে বহিষ্কার করা হয়।

এর আগে তৃণমূল বিএনপি নামে নতুন নিবন্ধিত দলে যোগ দেন বিএনপির সাবেক নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকার। তাদের সঙ্গে বিএনপির কিছু নেতাও রয়েছেন বলে তারা দাবি করেছেন।

বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সরকার দলের নেতাদের লোভ দেখিয়ে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে দল থেকে বহিষ্কৃত, দীর্ঘদিন ধরে পদবঞ্চিত কিংবা কার্যক্রমে অংশ না নেওয়া নেতাদের সরকার নিতে পারবে, তাতে বিএনপির ক্ষতি হবে না।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এবং দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনমুখী দল এবং বিভিন্ন সময় জনগণের ভোটে ক্ষমতায় গেছে। দেশের জনগণ গত দুটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিএনপি আন্দোলন করছে। কিন্তু সরকার জনদাবি উপেক্ষা করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পথে না হেঁটে একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। দেশ ও দেশের জনগণকে কঠিন সংকটের মুখে ফেলতে যাচ্ছে।’ তিনি বিশ^াস করেন, বিএনপির পরীক্ষিত নেতারা সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। বরং সরকারের লোভে পড়ে যারা সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন, তারা আরও বেশি জনবিচ্ছিন্ন হবেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপি সবসময় শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সারা দেশের অসংখ্য নেতাকর্মীকে কারাগারে নিয়েছে। কিন্তু তারপরও বিএনপি শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

বিএনপির চলমান আন্দোলনে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা এমনকি জেলা পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের অনেকে রাজপথে নামছেন না। তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে রাজপথে নামছেন। যার কারণে আন্দোলন বেগবান হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আন্দোলনের সফলতা আদৌ আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. জাহিদ বলেন, ‘রাজপথে নামার পরিবেশ তো সরকার রাখেনি। কার্যালয় পর্যন্ত দখল করে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।’ তবে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে শিগগিরই বেশিরভাগ নেতাকর্মী রাজপথে নামবেন এবং আন্দোলন সফল হবে বলে মনে করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী ৯ বছর আন্দোলন করেছে বিএনপি। তখন নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এরশাদের পতনের পর যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে বিএনপি জয়লাভ করেছে। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এবার নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে বিএনপি সে নির্বাচনে যাবে না।’ সূত্রঃ দেশ রূপান্তর

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.