বিশ্বরাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে উহানকে ঘিরে

চীনের জৈবপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির প্রতিষ্ঠা ১৯৫৬ সালে। প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্ববাসীর আলোচনায় নিয়ে এসেছে বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব। রোগটির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কভ-২ (নভেল করোনাভাইরাস) এখান থেকেই ছড়িয়েছে বলে সম্প্রতি এক মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। এর ভিত্তিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এজন্য সময় বেঁধে দিয়েছেন তিন মাস। অন্যদিকে বিষয়টিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চীন বলছে, চলমান মহামারীর উত্পত্তির সঙ্গে ল্যাবটির কোনো সংশ্লিষ্টতাই নেই।

শুরু থেকে এ পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসের প্রকৃত উত্পত্তিস্থল নির্ধারণে গলদ্ঘর্ম হয়েছে বৈজ্ঞানিক মহল। এমনকি ভাইরাসটি প্রাকৃতিক নাকি গবেষণাগারে উদ্ভাবিত, সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে পারছেন না গবেষকরা। যদিও এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ তোলপাড় ফেলে দিয়েছে বিষয়টি। বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে অনেক।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে দাবি করেছিলেন, উহানের ওই গবেষণাগার থেকেই করোনার সংক্রমণ ছড়িয়েছে। সে সময় এ নিয়ে জল ঘোলাও হয়েছিল অনেক। এরপর জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর আলোচনাটি কিছুদিনের জন্য ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এ নিয়ে তদন্ত চালাতে নির্দেশ দেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আবারো নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।

তার এ নতুন পদক্ষেপের ভিত্তি মার্কিন একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন। মহামারীর প্রাদুর্ভাব শুরুর আগেকার বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে এতে ইঙ্গিত দেয়া হয়, ভাইরাসটি সম্ভবত উহানের গবেষণাগার থেকেই প্রথম ছড়িয়েছে। অন্যদিকে চীন বিষয়টিকে অস্বীকার করে বলছে, মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন যে ভুল তথ্য দিতে পারে ইরাক যুদ্ধের সময়েই সেটা প্রমাণ হয়েছে।

এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার উত্তপ্ত বাদানুবাদের মধ্যেই সার্বিক বিষয় নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছে ডব্লিউএইচও। সংস্থাটি বলছে, করোনার প্রকৃত উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে রাজনীতির বিষাক্ত অনুপ্রবেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসটির উত্পত্তিস্থল যা-ই হোক, গোটা বিতর্কটি উন্নত দেশগুলোর জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণার এক অন্ধকার অধ্যায়কে সামনে নিয়ে এসেছে। অতীতেও বিভিন্ন উেস প্রকাশিত তথ্যে দেখা গিয়েছে, প্রযুক্তিতে অগ্রসর উন্নত দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। গেইন অব ফাংশন হিসেবে পরিচিত এসব গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো জীবাণুর বৈশিষ্ট্য বদলে দেয়ার মাধ্যমে এগুলোকে আরো প্রাণঘাতী ও টিকা প্রতিরোধী করে তোলা। পরীক্ষাগারে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এ নিয়ে গবেষণা চালান বিজ্ঞানীরা। এর মধ্য দিয়ে কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া যদি গবেষণাগারের নিরাপত্তাবলয় এড়িয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেক্ষেত্রে তা ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এফটি জানাচ্ছে, ২০১৪ সালে কিছু ভাইরাস নিয়ে এমন গেইন অব ফাংশন গবেষণায় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সে সময় মার্কিন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কঠোর গাইডলাইনও তৈরি করেছিলেন। ২০১৭ সালে এ নিয়ে আরো কিছু বিধিবিধান চালু হয়। কিন্তু এ ধরনের গবেষণা বন্ধ হয়নি এবং প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, এসব গবেষণা হচ্ছে মার্কিন অর্থায়নে। এমনকি করোনার উৎস হিসেবে অভিযুক্ত উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির গবেষণাগারেও মার্কিন অর্থায়নেই এ ধরনের গবেষণা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমটি জানায়, ২০১৫-২০ সাল পর্যন্ত উহান ইনস্টিটিউটে পরিচালিত এমন এক গবেষণায় মোট ৬ লাখ ডলার অর্থায়ন করেছে ওয়াশিংটন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ১৫ জন বিজ্ঞানী এ গবেষণা চালান। এর বিষয়বস্তু ছিল বাদুড় থেকে সংক্রমিত করোনাভাইরাস (করোনাভাইরাস বলতে প্রকৃতপক্ষে বোঝায় সমজাতীয় একগুচ্ছ আরএনএ ভাইরাসকে, যা স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম। সার্স, মার্স, নভেল করোনাভাইরাস—এগুলোর সবই করোনাভাইরাস উপপরিবারভুক্ত ভাইরাসের উদাহরণ) মানুষের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক অ্যান্থনি ফাউসি গত সপ্তাহে মার্কিন সিনেটে অনুষ্ঠিত এক শুনানিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।

চীনের ব্যাটউইম্যান হিসেবে পরিচিত শি ঝেংলিও ওই গবেষণাকারীদের অন্যতম ছিলেন। গবেষকরা ভিন্ন দুটি করোনাভাইরাসের নতুন একটি সংকর ও আরো ভয়ংকর প্রজাতি উদ্ভাবন করেন। ২০১৫ সালে নেচার জার্নালে ওই বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রেও উঠে এসেছে, নতুন ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম।

শুনানিতে ফাউসি দাবি করেন, এটি কোনো ধরনের গেইন অব ফাংশন-সংশ্লিষ্ট গবেষণা ছিল না।

২০১৫ সালের ওই গবেষণায় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, গেইন অব ফাংশন-সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলো অনেক বেশি বিপজ্জনক। ভয়াবহ প্যাথোজেন (জীবাণু) তৈরি করার আগে ভবিষ্যতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া থেকে সুরক্ষা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও নিয়ে রাখা আবশ্যক।

সার্স-কভ-২ গবেষণাগার, নাকি বাদুড় থেকে অন্য কোনো প্রাণী হয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে, সে বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আসেনি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি ২০১৫ সালের ওই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বিজ্ঞানী র্যালফ ব্যারিক এক খোলা চিঠিতে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য না আসছে, ততক্ষণ আমাদের দুটি সম্ভাবনাকেই আমলে নেয়া উচিত।

অন্যদিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজি বিভাগের অধ্যাপক মার্ক লিপসিচ এফটিকে বলেছেন, যেসব গবেষণার কারণে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে, জনস্বাস্থ্যে এর প্রভাব বিবেচনায় পর্যাপ্ত যুক্তি ছাড়া তা হাতে নেয়াই উচিত নয়।

চলতি বছরের শুরুর দিকে ডব্লিউএইচও একটি তদন্ত চালায়। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো গবেষণাগার থেকে সার্স-কভ-২ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। তবে এ তদন্তের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এমনকি ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাডহ্যানম গেব্রেইসুসও বলেছেন, তদন্তটিকে পর্যাপ্ত বলা চলে না।

সার্স-কভ-২ ভাইরাসটি আদতেই গবেষণাগারে ছড়িয়েছে কিনা, সে বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে দেখতে গত সপ্তাহে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন জো বাইডেন। এ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশনা হলো ৯০ দিনের মধ্যে এ নিয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। অন্যদিকে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ভাইরাসটি গবেষণাগার থেকে ছড়ানোর কোনো সম্ভাবনাই নেই। একই সঙ্গে ধারণাটিকেও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে আখ্যা দিয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো।

এদিকে বিষয়টি নতুন করে পাদপ্রদীপের আলোয় আসায় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথও (এনআইএইচ) বেশ বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। ইকোহেলথ অ্যালায়েন্স নামে বেসরকারি একটি সংস্থার মাধ্যমে উহানের ল্যাবে পরিচালিত গবেষণায় অর্থায়ন করেছিল এনআইএইচ। ফাউসির মতো সংস্থাটিও দাবি করছে, উহানে এর গবেষণা কার্যক্রমে গেইন অব ফাংশনের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। মানুষের মধ্যে অতিমাত্রায় সংক্রামক কোনো প্যাথোজেন তৈরিও এ গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল না।

এনআইএইচের অর্থায়নে উহানে পরিচালিত গবেষণাটির সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু এখনো বেশ গোপনীয়। গবেষণাটি করতে যাওয়াই উচিত হয়নি বলে মনে করছেন নিউ জার্সিভিত্তিক রুটগার্স ইউনিভার্সিটির কেমিক্যাল বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড এব্রাইট।

তার ভাষ্যমতে, কভিড-১৯ মহামারী গবেষণাগার থেকে ছড়াক বা না ছড়াক, এ ধরনের গবেষণায় অর্থায়ন বা সহযোগিতা করতে যাওয়াটাই উচিত হয়নি।

এছাড়া তিনি উহানের গবেষণাগারের নিরাপত্তামান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, শি ঝেংলি ও ইকোহেলথের পরিচালক পিটার দাসজাক ২০১৬ সালেও উহানের বায়োসেফটি লেভেল-২ (বিএসএল-২) গবেষণাগারে জীবন্ত করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। এনআইএইচের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাটির জন্য বিএসএল-২ গবেষণাগার যথেষ্ট ছিল না। কারণ এসব ল্যাব ব্যবহার হয় মূলত তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে। এসব গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা সাধারণত শুধু ল্যাব কোট ও গ্লাভস পরেই তাদের গবেষণা কার্যক্রম চালান।

রিচার্ড এব্রাইট বলেন, যদি কাজটি করতেই হয়, তবে তা অবশ্যই কোনো বিএসএল-২তে চালানোর মতো না। এর সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সাধারণ একটি ডেন্টিস্টের অফিসের সঙ্গেই তুলনা দেয়া চলে।

বর্তমানে চীনের সবচেয়ে বিপজ্জনক জৈব গবেষণা কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হচ্ছে বায়োসেফটি লেভেল-৪ (বিএসএল-৪) গবেষণাগারে। উহানে প্রথম বিএসএল-৪ ল্যাব চালু হয় ২০১৮ সালে।

বিজ্ঞানীদের বড় একটি অংশ মনে করছেন, কভিড-১৯-এর উত্পত্তি যেভাবেই হোক, এ মহামারীর অন্যতম বড় শিক্ষা হলো গেইন অব ফাংশন-সংক্রান্ত গবেষণাগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.