মৌলভীবাজারে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা করিয়ে ফেঁসে গেলেন সাক্ষী

মৌলভীবাজারের এক সাংবাদিকের বাড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ এনে এক তরুণীর করা মামলায় তিন আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলার রাজ সাক্ষী ওই সাংবাদিককে অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আফিয়া বেগম ১৬ নভেম্বর এই আদেশ দেন।

এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন আসামিপক্ষের একাধিক আইনজীবী।

ঘটনা

২০২০ সালের ৩ আগস্ট রাতে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সোনাপুর এলাকায় সাংবাদিক মাহমুদ এইচ খানের বাসায় ঘটনার সূত্রপাত ঘটে বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আবুল হাসান। আরও জানান, সে রাতে ওই বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন জানিয়ে ২৮ দিন পর সদর থানায় মামলা হয়।

তিনি জানান, মামলায় ধর্ষণের অভিযোগে আসামি করা হয় ওই নারীর বন্ধু সজিব তুষারকে। আর ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগে আসামি করা হয় আইনজীবী রায়হান আনসারী ও অধিকারকর্মী মার্জিয়া প্রভাকে। সাক্ষী হিসেবে রাখা হয় সাংবাদিক মাহমুদ এইচ খানকে।

আইনজীবী আবুল হাসান জানান, মামলার তদন্ত শেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি এ বছর আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে তিন আসামির বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। আর একই মামলায় সাক্ষী মাহমুদ এইচ খানকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে গত সেপ্টেম্বরে বাদীর পক্ষ থেকে না-রাজি দেয়া হয় আদালতে।

আবুল হাসান বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ১৬ নভেম্বর বাদীর না-রাজির পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে না-রাজি নাকচ করেন। আদালত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে এজাহারভুক্ত ৩ আসামিকে অব্যাহতি দেন এবং সাক্ষী মাহমুদ এইচ খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসায় তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছেন।’

অব্যাহতি পাওয়ারা কি বলছেন

অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে সজিব তুষার বলেন, ‘একটা মব মেন্টালিটি শুধু মাত্র অভিযোগের ভিত্তিতেই যদি একজন নিরপরাধ মানুষকে ধর্ষক বানিয়ে দিতে পারে। তার সামাজিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যারা মব জাস্টিস বা এ ধরনের বুলিংয়ের মাধ্যমে কয়েকটা জীবনকে তছনছ করে দেয়, মানসিক ধর্ষণ করে, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয় না কেন?’

অব্যাহতি পাওয়া আরেকজন মারজিয়া প্রভা। তিনি জানান, মিথ্যা মামলায় তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে অবশেষে তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, ফেসবুকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মব ট্রায়াল সংঘটিত করে আমাদের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছে। এই মব ট্রায়ালের ভয়ংকর পরিণতিতে সেদিন মিথ্যা বিকৃত তথ্যগুলোকে সত্য হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছিল, যা আমার সামাজিক জীবনকে ভয়াবহ করে তুলেছিল।

‘আমি চাকরি হারিয়েছিলাম, আমি কোথাও যেতে পারতাম না… মৌলভীবাজার আদালত দেশের নাগরিক হিসেবে আমাকে সুযোগ দিয়েছে নিজেকে নির্দোষ হিসেবে প্রমাণ করার।’

বাদী পক্ষের কথা

এই তদন্ত প্রতিবেদন সত্য নয় দাবি করে মামলার বাদী একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ধর্ষণে সজিব তুষারই জড়িত, মাহমুদ নয়। বিচারের জন্য তিনি উচ্চ আদালতে যাবেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন সাক্ষী মাহমুদ এইচ খান। তিনিও উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন।

তদন্ত কর্মকর্তা কি বলছেন

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দ্বীপরাজ ধর জানান, সাক্ষী মাহমুদ এইচ খান ও বাদীর কথামতো তিনি আলামত সংগ্রহ করেছেন। তবে আসামি সজিব তুষারের ডিএনএ আলামতে পাওয়া যায়নি। সেখানে বাদী ও মাহমুদের ডিএনএ পাওয়া গেছে।

তিনি বলেন, ‘আদালত সব বুঝে তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেছে। এই মামলার তদন্তে কী এসেছে, তার বড় একটি গতিপথ নির্ণয় করেছে ডিএনএ রিপোর্ট। কোনো প্রভাব বা কোনো কিছুই এখানে ছিল না। থাকলে আদালত বাদীর না-রাজি গ্রহণ করত।’

উল্লেখ্য, মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ঘটনার রাতে মাহমুদের বাড়িতে বন্ধু তুষারের সঙ্গে বেড়াতে যান বাদী। সেখানে মাহমুদের অতিথি হিসেবে ছিলেন রায়হান ও মার্জিয়া। সেখানে তারা সবাই গাঁজা খান। এরপর বাদীকে একটি রুমে নিয়ে ধর্ষণ করেন তুষার। মাহমুদ বিষয়টি টের পেয়ে বাধা দিতে গেলে তাকে বাধা দেন রায়হান ও মার্জিয়া। পরদিন সকালে বাদী মাহমুদকে ধর্ষণের বিষয়টি জানান। মাহমুদ এই ঘটনা নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট দিয়ে জানান।

এ ঘটনার ২৮ দিন পর ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট থানায় মামলা করেন ওই তরুণী।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.