সরকারি ওষুধ সিন্ডিকেটের পেটে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগে গত ১০ নভেম্বর চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন সিরাজুল ইসলাম (৪৫)। চিকিৎসক তাকে এন্টাসিড, বিসি/রেনোভিট, ক্যালসিয়ামসহ ৬ ধরনের ওষুধের নাম লিখে দিয়েছেন। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে তাকে দেয়া হয়েছে এন্টাসিড, ক্যালসিয়াম ও বিসি/রেনোভিট। বাকি ওষুধগুলো বাইরে থেকে কিনে নিতে বলা হয়েছে। ওইদিনই বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজন রোগী জানালেন, হাসপাতাল থেকে কোন কোন ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হয় তা তারা জানেন না। লালবাগ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা হোসনে আরা বেগম (৪২) বলেন, গ্যাসের জন্য হাসপাতাল থেকে দেয়া হয় এন্টাসিড। আমি পেন্টোনিক্স ৪০ খাই। আমার এই এন্টাসিডে কাজ হয় না। এই ওষুধ দিয়ে আমার কী হবে?

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন বিভাগে চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ভর্তি হন মালেকা বেগম (৫৬)। তার ছেলে হাবিবুর রহমান জানান, মালেকা বেগমকে নিয়ে তাদের ৮ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এই কয়েক দিনে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে তাদের। হাসপাতাল থেকে শুধু একটি এন্টিবায়োটিক ও একটি করে গ্যাসের ওষুধ দেয়া হতো তাদের।

লক্ষ্মীপুরের চন্দগঞ্জ থানা থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় লিভারের সংক্রমণে ভোগা ১৯ বছর বয়সি ফয়সাল হোসেনকে। পরে ভর্তি হন মেডিসিন বিভাগের ৭০১ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে চিকিৎসক তাকে হাই এন্টিবায়োটিক মেরোপেনেম ইনজেকশন লিখে দেন। চিকিৎসকের পরামর্শে প্রতিদিন তাকে একটি করে ইনজেকশন দেয়ার কথা।

সরকারিভাবে এই ইনজেকশন বরাদ্দ থাকলেও ২টি ইনজেকশন ২ হাজার টাকা দিয়ে তাদের কিনতে হয়েছে। তাও আবার ৭০১ নম্বর ওয়ার্ডের ডিউটিরত সিনিয়র স্টাফ নার্স বিপ্রজিত মণ্ডলের কাছ থেকে। বিষয়টি জানাজানি হলে কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয়। পরে এ বিষয়ে লিখিতভাবে ভুল স্বীকার করেই খালাস পান বিপ্রজিত মণ্ডল।

সরকারি হাসপাতালে রোগীদের ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগটি যে সত্য- তা ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদের এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে মাত্র ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ পান এবং ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়।

অধিকাংশ রোগীকে বেসরকারি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয় এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নিতে হয়। এতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. নুরুল আমিন ‘রোগী নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার জন্য উচ্চ ব্যয়ের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে জানান, রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয়ের প্রধান উৎস হলো ওষুধ। এই খাতে ব্যয় প্রায় ৬৪ ভাগ। হাসপাতালে অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়ার মাধ্যমে যথাক্রমে ১২ ও ১১ ভাগ ব্যয় হয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ ওষুধ দেয়া হয় না। এবং রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে না।

সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধের পাশাপাশি স্যালাইন, ইনজেকশন, সিরাপ, ড্রপ, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, স্যাভলন, হেক্সিসল প্রভৃতি দেয়ার কথা। ঢামেকে সরকারিভাবে ২২০ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও ইনজেকশনও আছে; যেগুলো রোগী বিনামূল্যে পেতে পারেন। এখন প্রশ্ন, কোন কোন ওষুধ হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়- সেই তথ্য সাধারণ রোগীরা জানবেন কীভাবে? যদি হাসপাতাল থেকে ওষুধ সরবরাহ করাই হয় তাহলে সেগুলো সাধারণ রোগীরা পায় না কেন?

এর উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাসামগ্রীসহ ওষুধ বাইরে পাচার হচ্ছে। এই পাচারে সক্রিয় একাধিক সিন্ডিকেট। হাসপাতালের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নার্স, ট্রলিম্যান, ওয়ার্ডবয়, ফার্মাসিস্ট এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মী পর্যন্ত এই সিন্ডিকেটের অংশ। আর এই কাজটি ৩টি স্তরে হয়ে থাকে। হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রথমে এসব ওষুধ দালালদের কাছে বিক্রি করে। দালালদের হাত ঘুরে চলে যায় বিভিন্ন ওষুধের দোকানে। পরে চড়া মূল্যে বিক্রি হয় ভোক্তাদের কাছে। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য সরবরাহ করা এসব ওষুধ পাওয়া যায় রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে। ওষুধের গায়ে সরকারি মনোগ্রামে ‘বিক্রি নিষেধ’ লেখা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে চড়া মূল্যে। এগুলো শুধু ঢাকা মহানগরীতে হচ্ছে তেমন নয়। এর অধিকাংশ ওষুধ ঢাকার বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়। সা¤প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বেশ কিছু সিন্ডিকেট সদস্য ধরাও পড়েছে।

হাসপাতাল থেকে বাইরে ওষুধ পাচার রোধে ২০১০ সালে সরকারি ওষুধের প্যাকেটের রং লাল ও সবুজ রংয়ের করা হয়। কিন্তু দৃশ্যপট খুব একটা বদলায়নি। এ প্রসঙ্গে ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ফর দ্য রুরাল পুওর-এর গবেষক জোবায়ের হাসান জানান, হাসপাতালের ওষুধ বাইরে বিক্রির পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত তারা নতুন বুদ্ধি বের করেছে। তারা হাসপাতালে ওষুধের মজুত সম্পর্কে রোগীদের জানায় না।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. নাজমুল হক বলেন, ঢামেকে আইসিইউ এবং এইচডিইউতে সব ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হলেও কিছু সময় সুবিধাভোগী লোকজন রোগীদের আত্মীয়দের দিয়ে ওষুধ কিনিয়ে থাকেন। এতে ঢাকা মেডিকেলের সুনাম নষ্ট হয়। এ অবস্থায় ওষুধসহ চিকিৎসাসামগ্রী পাচার ঠেকাতে স্টোরগুলোতে অটোমেশন প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। অটোমেশন পদ্ধতির মাধ্যমে সামনের দিনগুলোতে ওষুধ পাচারের সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এছাড়া অটোমেশন পদ্ধতিতে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের এ ধরনের চুরির জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। এসব বেআইনি কাজ করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

চলতি বছরের আগস্ট মাসে লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ উৎপাদন-বিপণন এবং সরকারি ওষুধ চুরি করে বিক্রি করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে ঔষধ আইন-২০২২ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, লাইসেন্স ছাড়া ঔষধ উৎপাদন, বিপণন বা আমদানি করলে ১০ বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। একইভাবে সরকারি ঔষধ চুরি করে বিক্রি করলেও একই শাস্তি ভোগ করতে হবে। সূত্র; ভোরের কাগজ

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.