ভাল নেই বাঁশ-বেত শিল্পের কারিগররা

মানবেতর জীবনযাপন করছেন ঢাকার নবাবগঞ্জের বাশঁ ও বেত শিল্পের কারিগররা। অন্য কোন কাজ না থাকায় এবং বাপ-দাদার পেশা হওয়ার কারণে অনেকেই অন্য পেশায় যেতে পারছেন না। করোনার পূর্বে কিছুটা ভাল থাকলেও হঠাৎ করে করোনাভাইরাসের কারনে মুখ থুবড়ে গেছে এ শিল্পের সাথে জড়িতরা। তবে নানা কারণে কেউ কেউ এখন বাপ দাদার পেশাকেও ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

একসময় সৌখিন মানুষ বাঁশ ও বেতের তৈরি পাখা, ঝাড়, টোপা, মাছ ধরার পলি, খলিশানসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাবপত্র ব্যবহার করতেন। কিন্তু বাজারে প্লাস্টিকের তৈরি নিত্য ব্যবহারের পণ্যের বাজার দখল করে নেয়ার কারণে এসব বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিস আর ব্যবহার করেন না। এতে বিপাকে পড়েছে এ শিল্পের সাথে জড়িতরা। তবে বাঁশ ও বেত শিল্পের কারিগররা বলছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত সবখানেই ব্যবহার করা হতো বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র। এখন সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে সবকিছুই। এর ব্যতিক্রম নয় ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলাতেও। তারপরও নবাবগঞ্জ উপজেলার গুটি কয়েক মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাঁশ আর বেতের শিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এই উপজেলায় বাঁশ ও বেত শিল্পের তৈরি মনকাড়া বিভিন্ন জিনিসের জায়গা দখল করেছে স্বল্প দামের প্লাস্টিক ও লোহার তৈরি পণ্য। তাই বাঁশ ও বেতের তৈরি মনকাড়া সেই পণ্যগুলো এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবে শত অভাব অনটনের মধ্যেও হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার আজও পৈতৃক এই পেশাটি ধরে রেখেছেন।

জানা গেছে, নবাবগঞ্জ উপজেলার শিকারীপাড়া ইউনিয়নের হাগ্রাদি, গরিবপুর এলাকায় ৩০-৩৫টি পরিবারই বর্তমানে এই শিল্পটি ধরে রেখেছেন। পুরুষদের পাশাপাশি সংসারের কাজ শেষ করে নারী কারিগররাই বাঁশ দিয়ে এইসব পণ্য বেশি তৈরি করে থাকেন।

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব বাঁশ শিল্পের কারিগররা তাদের পূর্ব পুরুষের এ পেশা ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে দিন দিন বিভিন্ন জিনিস-পত্রের মূল্য যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না এই শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মূল্য। যার কারণে কারিগররা জীবন সংসারে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন।

কয়েক দশক আগে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হতো এই কারিগরদের তৈরি পণ্য। এক সময় দোহার, নবাবগঞ্জ , মুন্সীগঞ্জ সহ দেশের ঘরে ঘরে ছিল বাঁশের তৈরি এইসব সামগ্রীর কদর। বাঁশ ও বেত থেকে তৈরি বাচ্চাদের দোলনা, পাখা, ঝাড়–, টোপা, মাছ ধরার পলি, খলিশানসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাবপত্র গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র বিস্তার ছিল। আগে যে বাঁশ ২০ থেকে ৩০ টাকায় পাওয়া যেত সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে দুইশত থেকে আড়াইশ টাকায়। কিন্তু পণ্যের মূল্য বাড়েনি। নেই কোন সরকারী সুযোগ সুবিধাও। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছে এই পেশার লোকজন। উপজেলার শিকারীপাড়া ইউনিয়নের হাগ্রাদি গ্রামের কারিগর বাশুদেব জানান, এই গ্রামের হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার আজও এ কাজে নিয়োজিত আছে। একটি বাঁশ থেকে ১০-১২টি ডালি তৈরি হয়। সকল খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পণ্য থেকে ১০-২০ টাকা করে লাভ থাকে। তাই এই সীমিত লাভ দিয়ে পরিবার চালান কষ্টের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাগ্রাদি গ্রামের নারায়ন নামের এক কারিগর জানান, তারা নিজেরাই বিভিন্ন হাটে গিয়ে ও গ্রামে গ্রামে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। এতে তেমন কোন লাভ হয় না। তাই জীবন ধারণ করা অনেক কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজলী নামের আরেক নারী কারিগর বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বাঁশ শিল্প টিকিয়ে রাখতে ধার-দেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে বেশি লাভ দিয়ে টাকা নিয়ে কোন রকমে টিকে আছি। আমাদের এই শিল্পটির উন্নতির জন্য সরকারিভাবে অল্প লাভে ঋণ দেয়া হয় তাহলে এই শিল্পটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

কারিগররা আরও জানান, মহিলারা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি বাঁশ-বেতের তৈরি সকল জিনিস তৈরিতে পুরুষের সমান পারদর্শী। যে কারণে সব প্রতিকূলতার মাঝে আজও অন্য কাজে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও এ শিল্পের কাজ করে যাচ্ছে।

সর্বোপরি, বাঁশ ও বেত শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কারিগর ও সর্ব মহলের ধারণা, আধুনিক সরঞ্জমের ব্যবহার কমিয়ে সরকারি, বেসরকারিভাবে কারিগরদের বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বাঁশ-বেত শিল্পকে টিকিয়ে রাখা উচিত।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.