বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততা

১৯৭৬ সালের ৩০ মে। দ্য সান ডে টাইমসে প্রকাশিত বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান জানায়, ‘খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে ও আমার ভায়রা আব্দুর রশিদ প্রথমে আমার কাছে মুজিবকে সরিয়ে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট পদে বসানোর প্রস্তাব দেন। আমি তাতে রাজি হই ও মেজর জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনীর প্রধান করার প্রস্তাব দিই। মুজিবকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনার পর মোশতাক ও জিয়া আমাদের পরিকল্পনায় সম্মত হন।’ ওই বছরের আগস্টে খুনি ফারুক রহমান এবং খুনি আব্দুর রশিদ ইংল্যান্ডের আইটিভি টেলিভিশনে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার কথা জিয়াউর রহমানের কাছে ব্যক্ত করলে জিয়া তাদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তাদের উৎসাহিত করে বলেন, তারা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গেই থাকবেন। খুনি কর্নেল ফারুক বলে, ‘আমাদের লিড করার জন্য জেনারেল জিয়াই ছিল মতাদর্শগতভাবে যোগ্যতম ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি।’ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক নেভিলে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। সাক্ষাৎকারটি যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।

জিয়ার জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত এই দুই খুনি। জিয়া তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। অভিযোগ অস্বীকার করে কোনো বিবৃতিও দেননি। বরং সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অংশে পরিণত করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জিয়ার সঙ্গে ফারুক-রশিদের সাক্ষাৎ এবং আলোচনা যে বহুবার হয়েছে- তার প্রমাণ মেলে রশিদের স্ত্রী জোবায়দা রশিদের একটি বক্তব্য থেকেও। তিনি বলেন, ‘একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (রশিদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে জিয়া বলেন, এটি যদি সফল হয় তবে আমার কাছে এসো, আর যদি ব্যর্থ হয় তবে আমাকে জড়িত করো না।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে চার দশকেরও বেশি সময় গবেষণা করেছেন বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। ১৫ আগস্টের হত্যার ষড়যন্ত্র বিষয়ে ‘এন আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ নামে তথ্যসমৃদ্ধ বইও লিখেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ অনুসন্ধানের পর জিয়ার আমলে সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের বিচারের অনুসন্ধানও করেছিলেন তিনি। তখন বাংলাদেশ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

গত ২০২০ সালে আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ১৯৭৫: সেটিং দ্যা ক্লক ব্যাক’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গটি আবারও সামনে নিয়ে আসেন লিফশুলজ। আলোচনায় লিফশুলজ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার বিভিন্ন দিকও তুলে ধরেন। সেখানে মেজর জিয়াউর রহমান ও তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের যোগাযোগের বিষয়ে তিনি কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের সমর্থন ছাড়া তারা মুভ করেননি। আর জিয়া মার্কিন সমর্থন ছাড়া কিছু করেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার এক সপ্তাহ আগে মার্কিন দূতাবাসের এক সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ঢাকায় সিআইএর স্টেশন প্রধান ফিলিপ চেরির সঙ্গেও জিয়া একান্ত বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা ছয়মাস আগে হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত হয় এক সপ্তাহ আগে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় জিয়া অন্য সৈন্যদের ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে যেতে দেননি। সেনবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে তিনি হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং এই ক্যু-র বিরুদ্ধে যাতে কেউ অবস্থান না নেয় তা তিনি নিশ্চিত করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে জিয়া ঢাকায় এক ব্যবসায়ীর বাসায় চেরির সঙ্গে বৈঠক করেন। জিয়া ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনার কেন্দ্রে।’

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.