
দেশের বৃহত্তম বাজেট প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে এমন সময়ে, যখন করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতে দ্বিতীয় ধাক্কা মানুষের অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি মানসিক সংকটকেও বাড়িয়ে তুলেছে। গত বছর জুড়ে যা হয়েছে তা নিয়ে হাহাকার আর যা আগামীতে হতে যাচ্ছে তা ভেবে আতঙ্কিত বোধ করছেন তরুণ, যুবক, মধ্যবয়সী মধ্যবিত্ত, মা ও গৃহিণীরা। ছাত্র ও যুবকরা ভাবছেন কি হবে ভবিষ্যতে! শ্রমজীবীরা ভাবছেন জীবিকার সংস্থান না হলে জীবন বাঁচবে কীভাবে! সবাই ভাবছেন সুরক্ষিত থাকার নামে এই বন্দিত্ব আর কতদিন স্থায়ী হবে? বাসাভাড়া, বাজার খরচ, টিউশন ফি জোগাড় হবে কীভাবে? আয়ের খাত স্থবির এবং আয় কমে গেলেও ব্যয়ের গতি তো কমেনি বরং বেড়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। বিভিন্ন জরিপ এবং গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় দেশে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১২ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে ২২ শতাংশ মানুষ ছিলেন, করোনায় তা বেড়ে ৫০ শতাংশ হয়েছে। সে হিসেবে দেশের সাড়ে ৮ কোটি মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে। নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত যে সাড়ে চার কোটি মানুষ ছিল বলে ধারণা করা হতো এবং যারা দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারের প্রধান ক্রেতা তারা অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়েছেন করোনার ধাক্কায়। দেশের ৪৪ লাখ মানুষ ধনী, তাদের জীবনে করোনা কি আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে করোনাকালে কোটিপতি বেড়েছে প্রায় ১০ হাজারের বেশি। ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত বেড়েছে এ রকম মানুষের সংখ্যা নাকি ৬৯ জন। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে তার অর্থ যাদের আয় বেড়েছে তার পরিমাণ এত বেশি যে তা বেশির ভাগ মানুষের আয় কমলেও সামগ্রিক আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই পুরনো কথা নতুন করে বলতে হয় শ্রেণিবিভক্ত সমাজে অনেকের দুর্যোগ কারও কারও জীবনে অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু এটা তো সত্যি যে, করোনা প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়েছে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে।
এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয় হিসেবে করোনা সংক্রমণ শুধু স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রের অবহেলা ও মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরেছে তা-ই নয়, উন্মোচন করেছে উন্নয়নের এত গল্প সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা কত। করোনার ভয়াবহ আক্রমণের সময়েও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হয়েছিল ২৯,২৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ তুলনামূলক বিচারে আগের বছরের ৫.৮ শতাংশ থেকে কমে ৫.১ শতাংশ হয়েছিল। জেলা শহরের হাসপাতালে হাই ফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে গড়ে ১৫ কোটি টাকা লাগার কথা। স্বাস্থ্য খাতে গত বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ হয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র ২৫০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, ৭৫০০ কোটি টাকা এখনো অব্যবহৃত। অথচ এখনো দেশের প্রতিটি জেলা শহরের হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা করা হয়নি। চিকিৎসাপ্রাপ্তির আশা সাধারণ মানুষ অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, অনেক নামিদামি মানুষের করোনায় চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু দেখে। একটা কথা তো বেশ ভালোই প্রচার পেয়েছে যে, মৃত্যুবরণ করলে আপনি সরকারের কাছে একটি সংখ্যা কিন্তু প্রিয়জনের কাছে অনেক বড় শূন্যতা। অর্থাৎ নিজের দায়িত্ব নিজেই নাও।
এই করোনায় দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে সবচেয়ে উপেক্ষিত খাত বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক। চার কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন করে শুধু ভাতের সংস্থান করা নয়, সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস, ফল কোনো কিছুরই অভাব বোধ করতে দেয়নি, ৪৭ শতাংশ কর্মসংস্থান করেছে যে খাত গত বাজেটে সবচেয়ে উপেক্ষিত ছিল সেটি। গত বাজেটে মাত্র ৩.৫ শতাংশ বরাদ্দ, বোরো ও আমন কোনো মৌসুমে সরকার নির্ধারিত ধানের মূল্য না পাওয়া, সস্তা দামে বিক্রি করে সবজি চাষির দুঃখ, মৌসুমি ফল নিয়ে বিড়ম্বনায় উৎপাদক, মৎস্য ও পোলট্রি খামারির দুর্ভোগ, দাম না পেয়ে এবং বিক্রি করতে না পেরে দুগ্ধচাষি বিপাকে এসব খবর ছিল পত্রিকার নিয়মিত হেডলাইন।
দেশের অর্থনীতির আর একটি বড় চালিকাশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। দেশের কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশ এই খাতে আর অর্থনৈতিক আয়তনের ৫০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে এই খাতের শ্রমজীবীরা। তাদের কাজ নাই তো মজুরি নাই। গত ৪ মাসে তাদের জীবন কীভাবে কেটেছে তার বর্ণনা দেওয়া কঠিন। ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমশক্তির সাড়ে পাঁচ কোটি শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। তারা কতটুকু সহায়তা পেয়েছে এবং কতজন পেয়েছে তা উল্লেখ করার মতো নয়। তাদের জন্য যে সামান্য টাকা বরাদ্দ ছিল নানা দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও তার ৫০ শতাংশও বিতরণ করা হয়নি। করোনা এদের নিম্নবিত্ত থেকে দরিদ্রের কাতারে নামিয়ে এনেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ মাস বন্ধ। দেশের ৯৩ শতাংশের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক-কর্মচারী বেসরকারি। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এদের কষ্টের সীমা ছিল না।
প্রবাসী আয় বড় ধাক্কা থেকে দেশকে বাঁচিয়েছে করোনাকালে এবং তারপরে। বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিক যাওয়ার খরচ শ্রমিক প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা নগণ্য, রিক্রুটিং এজেন্সির নামে মানব রপ্তানির ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া প্রভাব এখানে। প্রতি বছর গড়ে ৮ লাখ যুবক-যুবতী কাজের সন্ধানে দেশের বাইরে যেত, সেটা কমে ২ লাখে নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসা শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভর দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে, তেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে এবং সহসাই তা বাড়বে বলে মনে হয় না। ফলে ব্যাপকভাবে চাকরি হারাবে প্রবাসী শ্রমিকরা। ফিরে আসা শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থার দায়িত্ব নেবে কে? করোনাকালে ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল প্রবাসী শ্রমিকরা। কিন্তু যে শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছে তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ছিল না। এবারও কি তাই হবে?
করোনা এবং করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটগুলোর সমাধানের দিকনির্দেশনা থাকার কথা ছিল বাজেটে। কিন্তু যত বলা হয়েছে, বাস্তবে তত লক্ষ করা যায়নি। করোনা বিপর্যয় সামাল দিতে সরকার যেসব প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল তা খেয়াল করলে দেখা যাবে, অর্থনীতির ও জনগণের এ বিষয়গুলো সেখানে তেমন গুরুত্ব পায়নি, যতটা গুরুত্ব পেয়েছেন বড় শিল্পপতিরা। আর ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার সহায়তার মধ্যে ৯০ হাজার কোটি টাকাই ছিল ব্যাংকঋণ। করোনার আঘাত সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও দেখাল যে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়া যেকোনো দুর্যোগে টিকে থাকা কত কঠিন আর বিদেশি বাজারের দিকে তাকিয়ে উৎপাদন পরিকল্পনা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৃষি, কৃষক আর ক্ষুদ্র পুঁজির মালিকরা যদি উঠে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি আর জিডিপি বৃদ্ধির প্রচার করে বৈষম্য আর দারিদ্র্য আড়াল করা যাবে না।
এ পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বাজেট আসছে। বাজেট তো শুধু অর্থনীতির হিসাবনিকাশ নয়, বাজেট একটি অর্থনৈতিক দর্শনও বটে। বাজেটে কে গুরুত্ব পাবে আর কে গুরুত্ব হারাবে তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা। কিন্তু বাজেটের অর্থনৈতিক দিকগুলো আলোচনার ক্ষেত্রে যত মনোযোগ পায় নৈতিক দিকের আলোচনা ততটাই অবহেলিত থাকে। বিগত বছরগুলোতে ঋণখেলাপি, ব্যাংক ডাকাত, টাকা পাচারকারীরা সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। এবারের বাজেটেও সেই ধারা অব্যাহত থাকবে। ইতিমধ্যেই অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যত দিন কালোটাকা থাকবে, তত দিন সাদা করার প্রক্রিয়া চলবে।
করোনার অভিঘাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা বাড়ানো, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, গবেষণা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত এসব কথা আমরা শুনছি অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে বাজেট প্রণয়নে নিয়োজিত যারা তাদের কাছে বা কানে পৌঁছালেও কাজে তার প্রতিফলন ঘটবে না। অতীতের ধারাবাহিকতা থেকে যে ধারণা করা যায়, তা হলোÑঅর্থনৈতিক অবস্থার দোহাই দিয়ে সরকারের আয় বাড়ানোর জন্য ট্যাক্সের আওতা বাড়ানো হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানো হবে আবার খেলাপি ঋণও বাড়বে। মেগা প্রকল্প, ঋণের সুদ পরিশোধ, সুবিধাভোগীদের আরও সুবিধা দেওয়া এসব ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াতে গিয়ে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, শ্রমজীবীদের রেশন, আবাসন, শিশুদের বিকাশ আর বৃদ্ধদের সুরক্ষার জন্য বরাদ্দে টান পড়বে। বাজেট প্রণয়নে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, বাজেটের বরাদ্দ ও ব্যবহারে জবাবদিহি ছাড়া যত বড় বাজেট হোক না কেন, তার সুফল আসে না। মানুষ ট্যাক্স দেবে বা দিতে বাধ্য হবে কিন্তু এই টাকা কোথায় খরচ হবে তা নিয়ে মতামত দিতে পারবে না। বিশাল বড় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি দেখবে, কিন্তু বছর শেষে দেখবে তার ৬০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়নি, টাকা অব্যবহৃত আছে। পরিকল্পিতভাবে শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে নিম্নমানের কাজ হবে, যার দুর্ভোগ পোহাবে শেষ পর্যন্ত জনগণ! ইতিমধ্যে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে, বাজেট যেদিন থেকে বাস্তবায়ন হবে সেদিন থেকে মানুষ পানির বর্ধিত দাম দিতে বাধ্য হবে। জনগণের কষ্টের টাকায় তৈরি বাজেট জনজীবনের কষ্ট বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হওয়ার এই প্রক্রিয়ার অবসান হওয়া দরকার। তা না হলে বিশাল বড় বাজেট, বিরাট বড় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি আর জনগণের ওপর বিপুল ভ্যাটের বোঝা, এই প্রক্রিয়াই কি অব্যাহত থাকবে?
লেখক, সম্পাদক মাসিক ভ্যানগার্ড ও শ্রমিক নেতা
Leave a Reply