ত্রাণ পৌঁছেনি প্রত্যন্ত জনপদে

সিলেটঃ যে দিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। কোনটা গ্রাম, কোনটা রাস্তা, কোনটা হাওর, কোনটা নদী বুঝে ওঠা দুষ্কর। কোথাও কোমর সমান তো, কোথাও আবার বুক সমান পানি। বন্যাক্রান্ত এলাকার প্রত্যন্ত পল্লীতে দুর্গতরা যে কী পরিমাণ কষ্টে থেকে জীবন বাঁচানোর লড়াই করছেন- তা দেখার যেন কেউ নেই। গত ৬ দিনেও এসব এলাকায় কেউ ত্রাণ নিয়েও যাননি। ফলে যে যেভাবে পারছেন কোনোরকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। গতকাল মঙ্গলবার দিনভর সিলেটের সদর উপজেলা, বিশ্বনাথ উপজেলা ও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলো দেখে এমন হৃদয়বিদারক চিত্রই পাওয়া গেছে। শুধু এই তিন উপজেলাই নয়, পুরো অঞ্চলের প্রত্যন্ত পল্লীতেই একই অবস্থা চলছে। সড়কের পাশে বসবাসকারী কিছু মানুষ বারবার ত্রাণ পাচ্ছে; কিন্তু দূরের গ্রামে পানিবন্দি মানুষ একেবারেই বঞ্চিত। এমনকি তাদের পাশে কেউ যাচ্ছেনও না। তবে জেলা দুটির শহর এবং রাস্তা থেকে পানি নেমে যাওয়ায় অনেকেই দোকান খুলে বসেছেন। দামও যে যার মতো করে নিচ্ছেন।

প্রত্যন্ত এলাকাগুলো এখনো পানির নিচে; সেখানে কোনো ত্রাণও পৌঁছেনি। এমনি একটি এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার ত্রাণ নিয়ে যায় সিলেট শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ওই দলের সহযাত্রী হন এই প্রতিবেদক। সিলেটের আলমপুর থেকে সুরমার ওপর দিয়ে যন্ত্রচালিত নৌকাভর্তি ত্রাণ নিয়ে রওয়ানা দেয়ার পর থেকেই প্রত্যন্ত এলাকার বানভাসিদের চিত্র ভেসে উঠতে থাকে। নদীর তীর থেকে দুর্গতরা ত্রাণভর্তি নৌকা ভেড়ানোর জন্য দু’হাত তুলে ডাকতে শুরু করেন। কোথাওবা কোমর সমান পানি সাঁতরে এসে দুর্গতরা ত্রাণ হিসেবে কয়েক কেজি চাল, তেল ও আলুর ব্যাগ নিয়ে গেছে। প্রায় তিন ঘণ্টা নৌকা চলার পর সেটি ভিড়ে ছাতক উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের নুরুল্লা গ্রামে। গ্রামটির একদিকে সুরমা নদী, অন্যদিকে রাতুয়াইল হাওর। কিন্তু বন্যার পানিতে কোনটা নদী আর কোনটা হাওর তা চেনা দুষ্কর।

স্থানীয় তরুণ কাওছার আহমেদ জানান, গত তিন দিন গ্রামের প্রায় সবাই না খেয়ে আছেন। প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় কেউ ত্রাণ নিয়েও আসেন না। সিলেট শিক্ষা বোর্ডই প্রথম কোনো প্রতিষ্ঠান হিসেবে ত্রাণসমাগ্রী দেয় তাদের। নিজের বর্ণনা দিয়ে ওই তরুণ জানান, তাদের দোতলা বাড়ি। পানির কারণে গত কয়েকদিন ধরে ছাদে ত্রিপল টানিয়ে থাকছেন। ঘরে যে ধান ছিল তাও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বন্যা ধনী-গরিব সবাইকে এককাতারে নামিয়ে এনেছে বলে মন্তব্য তার। এ কারণে ত্রাণ আসামাত্র লোকজন কে কার আগে নেবে তা নিয়ে হুড়োহুড়ি করেছে। ওই গ্রামেরই ষাটোর্ধ্ব আখলুছ মিয়া বলেন, বন্যা আমার ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। গাছে আটকে শুধু টিনগুলো আছে। ঘরের আর কিছুই নেই। এমনকি কয়েকদিন আগে ফসল হিসেবে ৩০ মণ ধান সংরক্ষণে রেখেছিলেন। বন্যা সেটিও ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় এখন তিনি পথে বসেছেন।

নুরুল্লা গ্রাম থেকে উজিরপুর যাওয়ার পথে রাতুয়াইল হাওরের ওপর দিয়ে দূরে দেখা গেল লাফার্জ সুরমা সিমেন্টের কারখানা। তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় সেখানে পানি উঠেনি। ফলে আশপাশের বহু মানুষ কারখানায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানালেন শিল্পী বেগম। তিনিও ত্রাণের প্যাকেট হাতে নিয়ে বললেন, ‘বাবারে আজ ত্রাণ নিতে কোনো শরম লাগছে না। ঘরে সবছিল, কিন্তু আজ কিছুই নেই। বাজারেও পানি। ফলে কিছু কেনাও যাচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে ওই একমুঠো ত্রাণই আমাদের কত শক্তি এনে দিয়েছে তা বলে বোঝানো যাবে না।

এরপর রামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল সেখানকার রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচতলা জলমগ্ন। কিন্তু দুতলায় প্রায় ৫০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তারাও ত্রাণ পেয়ে খুশি। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুরমার তীরের ওই গ্রামে হাজার দুয়েক পরিবারের বাস ছিল। বাঁশ-বেড়া দিয়ে তৈরি করা পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি বানের পানি নিমেষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। গতকাল থেকে পানি কিছুটা কমলে লোকজন এসে পানিতে ভাসিয়ে নেয়া ঘরে টিন, চাল, আলমারি, ধানের বস্তা কোথায় আছে তা খুঁজতে শুরু করেন। জানতে চাইলে সাফিয়া বেগম নামের একজন এসে বললেন, ঘর পানিতে ভেসে গেছে। এখন শূন্য। এই গ্রামের জনা বিশেক লোক এসে একটাই আবদার জানিয়ে বললেন, আমাদের ঘর তৈরি করে দেন। আমি কীভাবে সেটা করে দেব- প্রশ্ন করলে, তারা সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘আফনে আমরার নাম লেখি লাইলেই সরকারে ঘর দিব’।

বিশ্বনাথ উপজেলার ভেরাজপুর গ্রামের অবস্থা আরো ভয়ংকর। নৌকায় বসে দূর থেকে একটি পরিবারকে দেখা গেছে, বাথরুমের ছাদের উপর পর্দা টানিয়ে বাস করছেন। ফাহিমা নামে একজন জানালেন, তার লাখ টাকা মূল্যের দুটি গরু এবং ৫০ মণ ধান বানের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সঙ্গে ঘরের দেয়ালও ধসিয়ে দিয়ে গেছে। ঘর বলতে পানির ওপরে টিনের চাল ভাসছে। একই উপজেলার মীর্জারগাঁওয়ে এসেও একই চিত্র দেখা গেল। সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নের মাধবরপুর গ্রামে বৃদ্ধ জসিম উদ্দিনের বাড়ির পাশ দিয়ে নৌকা যেতে দেখে সাঁতরে কাছে এলেন তিনি। দূর থেকে দেখা গেল, বাড়িটি পানিতে তলিয়ে আছে। এই পানির মধ্যেও থাকছেন কেন- ত্রাণের প্যাকেট হাতে নিয়ে তিনি বললেন, এমনিতেই ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে। সম্বল বলতে ঘরের চালের টিনটুকু রয়েছে। এটিও যদি ডাকাতে নিয়ে যায় তাহলে মুসিবতে পড়ব। চাল পাহারা দেয়ার জন্যই তিনি পানির মধ্যে বাস করছেন বলে জানান।

এসব দৃশ্য দেখে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রমাবিজয় সরকার ভোরের কাগজকে বলেন, ওরা এত গরিব এবং প্রান্তিক পর্যায়ের যে, এত ক্ষতির পরও অল্প ত্রাণ পেয়েই খুব খুশি। আর আমাদের খুশি এই কারণে, প্রত্যন্ত পল্লীতে এসে অল্প পরিমাণে ত্রাণ দিয়ে যেতে পেরেছি। তিনি বলেন, প্রত্যন্ত পল্লীর বাসিন্দা হওয়ায় ওদের কেউ দেখছে না।

নৌকা থেকে নেমে সিলেট সদরে প্রবেশের আগে বিশ্বনাথের লামাকাজি বাজার ঘুরে দেখা গেল, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কটিতে অবস্থিত এই বাজারের রাস্তাঘাট-দোকান ডুবে গিয়েছিল বন্যার পানিতে। উঁচু জায়গা এবং রাস্তা থেকে সেই পানি গতকাল মঙ্গলবার কিছুটা কমেছে। তবে বাজারে অলিগলিতে এখনো হাটু ছুঁইছুঁই পানি রয়েছে।

বন্যা শুরুর ৬ দিনের মাথায় গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ওই বাজারে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে মাছ, মাংস, সবজিসহ অন্যান্য কাঁচাপণ্যের অস্থায়ী দোকান বসিয়েছেন বিক্রেতারা। সড়কের পাশের দোকানগুলো খোলা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ দোকান খুলে কোন কোন জিনিসপত্র পানিতে নষ্ট হয়েছে, তার হিসাব মেলাচ্ছেন।

ভিজে নষ্ট হওয়া জিনিসপত্র দোকানের বাইরে বের করে শুকাতে দিয়েছেন দোকানিরা। আর যেসব জিনিস নষ্ট হয়নি, সেসব বিক্রির জন্য গুছিয়ে রাখছেন। দোকান খুললেও ওই বাজারে বিদ্যুৎসংযোগ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। অনেক মুদি দোকানে ফ্রিজে রাখা খাদ্যপণ্য গলে-পচে নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে পানি কিছুটা কমে যাওয়ায় ছোট ছোট ডিঙিনৌকা ও সেচ যন্ত্রচালিত ট্রলারে করে খাবার কিনতে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাজারে আসেন মানুষজন।

জৈন্তাপুরে পানিতে ভেসে উঠল মা-ছেলের লাশ : সিলেটের জৈন্তাপুরে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া মা-ছেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকালে উপজেলার দরবস্ত এলাকায় পানিতে ভেসে ওঠে নাজমুন্নেসা ও তার ছেলে আব্দুর রহমানের মরদেহ। তারা দরবস্ত ইউনিয়নের কলাগ্রামের বাসিন্দা বলে জানা গেছে। এর আগে গত শুক্রবার পানিতে তলিয়ে যান মা-ছেলে। মা-ছেলের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য নিশ্চিত করে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল বশিরুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবার নাজমুন্নেছা তার ছেলেকে নিয়ে পাশের গ্রামে মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। মেয়ের বাড়িতে পানি উঠে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে মা-ছেলে সড়কের পাশে পানিতে তলিয়ে যান। আজকে তাদের মরদেহ ভেসে উঠেছে।

বন্যায় সিলেট বিভাগে ২২ জনের মৃত্যু : বন্যায় সিলেট বিভাগে ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়। পরিচালক হিমাংশু লাল রায় বলেন, এ পর্যন্ত বন্যায় সিলেট বিভাগে ২০ জনের মৃত্যুর তথ্য আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে সিলেটে ১২ জন, মৌলভীবাজারে তিনজন ও সুনামগঞ্জে পাঁচজন। মঙ্গলবার সকালে সিলেটের জৈন্তাপুরে মা-ছেলের মরদেহ ভেসে উঠেছে। তাৎক্ষণিক এ দুই মরদেহের তথ্য তার কাছে নেই। তবে এ তথ্য যোগ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সে অনুযায়ী, বন্যায় সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে সোমবার পর্যন্ত সিলেটের জেলা প্রশাসক একজনের, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তিনজনের ও ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে স্থানীয় সূত্রে আরো কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও সত্যতা নিশ্চিত করেনি প্রশাসন। তবে ভোরের কাগজ গতকাল মঙ্গলবার বন্যায় ১৩ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল।

তাহিরপুরে ত্রাণ নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে একজনের মৃত্যু : গত সোমবার বিকালে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বন্যা দুর্গতদের জন্য বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার থেকে দেয়া ত্রাণসামগ্রী নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে আহত ৬ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত বিপ্লব মিয়া (৫০) তাহিরপুর উপজেলা সদরের উজান তাহিরপুর গ্রামের শহীদ আলীর ছেলে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বিপ্লব মিয়ার স্ত্রী, ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। উজান তাহিরপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মতিউর রহমান মতি বিপ্লবের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সোমবার বিকালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার তাহিরপুর উপজেলা সদরের শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে। এ সময় কয়েক শতাধিক বন্যার্ত লোকজন শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে ত্রাণ সহায়তা নিতে গেলে হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণসামগ্রী নিচে ফেলার সময় সবাই হুড়োহুড়ি করে ত্রাণসামগ্রী ধরতে গেলে ঘটনাস্থলে ৬ জন আহত হয়। অন্যান্য আহতদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

আমাদের বাণী/২২/৬/২০২২/বিকম

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.