আট মার্কেটের ৮৮ শতাংশ দোকান দেয় না ভ্যাট

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের আটটি বিলাসবহুল মার্কেটে রয়েছে এক হাজার ২৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এর মধ্যে ভ্যাট নিবন্ধন নেই এবং ভ্যাট দেয় না ৯০৪টি প্রতিষ্ঠান। মানে আটটি মার্কেটের মধ্যে ৮৮ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেয় না। মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (ভ্যাট গোয়েন্দা) জরিপে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার ভ্যাট গোয়েন্দা দল আটটি মার্কেটে জরিপ সম্পন্ন করেছে। জরিপে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র উঠে এসেছে। ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

মহাপরিচালক জানান, ভ্যাট গোয়েন্দার উপপরিচালক তানভীর আহমেদ নারায়ণগঞ্জে, সহকারী পরিচালক মুনাওয়ার মুরসালীন ঢাকায় এবং সহকারী পরিচালক মালেকীন নাসির আকন্দ সাভারের মার্কেট জরিপ কাজে নেতৃত্ব দেন। তিনটি দলে ৪২ গোয়েন্দা কর্মকর্তা অংশ নেন। এই আটটি মার্কেট হলো নারায়ণগঞ্জের মার্ক টাওয়ার, সমবায় নিউমার্কেট, সায়েম প্লাজা, আল হাকিম (পপুলার) সেন্টার, সাভারের সিটি সেন্টার, ঢাকার ট্রপিক্যাল আলাউদ্দীন টাওয়ার উত্তরা, আরএকে শপিং কমপ্লেক্স উত্তরা এবং সুবাস্তু নজর ভ্যালি, বাড্ডা। এই জরিপে মোট দোকান পাওয়া যায় এক হাজার ২৪টি। এর মধ্যে মোট ভ্যাট নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ১২০টি। বাকি ৯০৪টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেয় না।

জরিপ অনুসারে, ভ্যাট নিবন্ধিত ১২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাসে পাঁচ হাজার টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় মাত্র ৪৫টি। বাকি ৭৫টি পাঁচ হাজার টাকার নিচে ভ্যাট দেয়। অথচ জরিপের ফল অনুসারে এদের অধিকাংশের দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ, অন্যান্য খরচ ও মুনাফা অনুসারে এই পরিমাণ ভ্যাট সংগতিপূর্ণ নয় বলে প্রমাণ মিলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাদের প্রায় সবাই ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে। কিন্তু তারা যথাযথভাবে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট পরিশোধ করে না।

মাঠ পর্যায়ের এই জরিপে আরও দেখা যায়, কোনো কোনো মার্কেট গড়ে উঠেছে ১০ বছরের অধিক সময় আগে। মার্কেটের অনেক ব্যবসাও একই সময়ের। নতুন ভ্যাট আইনও বাস্তবায়ন হয়েছে দুই বছর হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও জরিপে প্রাপ্ত ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় আসেনি। তবে সুভাস্তু নজর ভ্যালিতে ঢাকা উত্তর কমিশনারেট থেকে বৃহস্পতিবার পাঁচ শতাধিক দোকানকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন দিয়ে তা মার্কেটের নিচে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।

জরিপ প্রতিবেদন বলছে, মার্কেট থেকে ভ্যাট সংগ্রহে রাজধানীর চেয়ে ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভ্যাট প্রদানে অনীহা বেশি। এসব এলাকায় ভ্যাট আইন পরিপালন অপেক্ষাকৃত কম। গত ২৫ মে নরসিংদীর দুটো শীতাতপ মার্কেটের জরিপে দেখা যায়, মার্কেট দুটোর ২৩৭ প্রতিষ্ঠানের কেউই ভ্যাট প্রদান করে না। এই মার্কেটের নাম হলো নরসিংদীর স্টেশন রোডে ইনডেক্স প্লাজা ও জামান শপিং কমপ্লেক্স।

ভ্যাট গোয়েন্দার নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এলাকার ২৭ মের জরিপেও একই চিত্র ফুটে উঠেছে। এই দুই এলাকার ছয়টি মার্কেটের ৩৭২টির মধ্যে মাত্র ১৮টি ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণ করেছে। বাকি ৩৫৪টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতাভুক্ত নয়। যারা নিবন্ধিত তাদের অধিকাংশ আবার যথাযথভাবে ভ্যাট প্রদান করে না।

ভ্যাট গোয়েন্দার জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের মার্ক টাওয়ার ঢাকা (দক্ষিণ) কমিশনারেটের আওতাধীন একটি মার্কেট। এখানে দোকানের সংখ্যা ৩০টি। এর মধ্যে একটি দোকান ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে এবং পাঁচ হাজার টাকার উপরে ভ্যাট দেয়। অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ২৯টি। একই কমিশনারেটের আওতাধীন নারায়ণগঞ্জের সায়েম প্লাজা। এখানে মোট দোকান রয়েছে ৫০টি। এর মধ্যে একটি দোকানের ভ্যাট নিবন্ধিত রয়েছে এবং পাঁচ হাজার টাকার ওপরে ভ্যাট দেয়। ৪৫টি দোকানের নিবন্ধন নেই এবং পাঁচ হাজার টাকার নিচে ভ্যাট দেয় ৪৯টি দোকান।

জরিপে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের সমবায় নিউমার্কেট। এ মার্কেটে দোকানের সংখ্যা ৮০টি। এর মধ্যে একটি দোকানের ভ্যাট নিবন্ধন রয়েছে। নিবন্ধন নেই ৭৯টি। নারায়ণগঞ্জের আল হাকিম সেন্টার (পপুলার) এর দোকান রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে একটি দোকানের ভ্যাট নিবন্ধন রয়েছে এবং পাঁচ হাজার টাকার উপরে ভ্যাট দেয়। বাকি ১৩ দোকানের নিবন্ধন নেই, ভ্যাট দেয় না। ঢাকা (পশ্চিম) কমিশনারেটের আওতাধীন সাভারের সিটি সেন্টারে দোকানের সংখ্যা ১৯৮টি। এর মধ্যে ১০টি দোকানের ভ্যাট নিবন্ধন রয়েছে, যার মধ্যে আটটি দোকান পাঁচ হাজার টাকার ওপরে এবং দুইটি পাঁচ হাজার টাকার নিচে ভ্যাট দেয়। বাকি ১৮৮টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই।

আরও দেখা যায়, ঢাকা (উত্তর) কমিশনারেটের আওতাধীন রাজধানীর ট্রপিক্যাল আলাউদ্দিন টাওয়ারে দোকানের সংখ্যা ৮৩টি। এর মধ্যে ৫০টি দোকানের নিবন্ধন রয়েছে, যার আটটি পাঁচ হাজার টাকার ওপরে এবং ৪২টি পাঁচ হাজার টাকার নিচে ভ্যাট দেয়। ৩৩টি দোকানের নিবন্ধন নেই। একই কমিশনারেটের আওতাধিন আরএকে শপিং কমপ্লেক্স, উত্তরায় দোকানের সংখ্যা ৩৩টি। এর মধ্যে ২৬টি দোকানের নিবন্ধন রয়েছে এবং পাঁচ হাজার টাকার নিচে ভ্যাট দেয়। সাতটি দোকানের নিবন্ধন নেই।

উত্তর কমিশনারেটের আওতাধীন বাড্ডা এলাকার সুভাস্তু নজর ভ্যালিতে দোকানের সংখ্যা ৫২৬টি। এর মধ্যে ২৬টি জুয়েলারি দোকানের নিবন্ধন রয়েছে, যারা পাঁচ হাজার টাকার উপরে ভ্যাট দেয়। অবশিষ্ট ৫০০টি দোকান ভ্যাট প্রদান করে না। ঢাকা উত্তর কমিশনারেট থেকে বৃহস্পতিবার এই ৫০০ প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক ভ্যাট নিবন্ধন প্রদান করে তা মার্কেটের প্রাঙ্গণে ঝুলিয়ে দেয়া হয়।

মইনুল খান জানান, ভ্যাট আইন অনুসারে, যে কোনো ভ্যাটযোগ্য ব্যবসা শুরু করার আগেই নিবন্ধন গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। মার্কেটগুলোতে খুচরা পর্যায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট সংগ্রহ করে প্রতি মাসের ভ্যাট পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে স্থানীয় ভ্যাট সার্কেলে রিটার্ন জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। প্রতিটি বিক্রিতে ক্রেতাকে নির্দিষ্ট ফর্ম মূসক-৬.৩ এ চালান দিতে হবে। এনবিআরের নির্দেশে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর এই বিশেষ জরিপ করছে। এই লক্ষ্যে চারটি জরিপ দলও গঠন করেছে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এই চারটি দল মাঠে নেমে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের মার্কেটগুলোতে এই জরিপ করছে। এই জরিপে বিভিন্ন মার্কেট সমিতি ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা নিচ্ছে গোয়েন্দা দল। জরিপের এই ফলাফল এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন আকারে জমা দেয়া হবে। এর ওপর ভিত্তি করে এনবিআর কর্মকৌশল নির্ধারণ করবে। ভ্যাটযোগ্য ব্যবসাকে করের আওতাভুক্ত করা এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো এই জরিপের উদ্দেশ্য বলে জানান ড. মইনুল খান।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.