রসিদ ছাড়াই টেস্ট, স্বাক্ষর দেন টেকনিশিয়ান

ঢাকাঃ হঠাৎ পেট ফুলে যাওয়ায় গত সোমবার (১৩ জুন) রাতে মা রাশিদা বেগমকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মিরপুরের বাসিন্দা রনি। ভর্তির পর রোগীকে হিমোগ্লোবিন, রক্তের প্লাটিলেটসহ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করাতে বলেন ওয়ার্ডের দায়িত্বরত চিকিৎসক। পরে পরীক্ষার জন্য নমুনা নিয়ে প্যাথলজি বিভাগে আসেন রনি। সেখানে কোনো রসিদ ছাড়াই টাকা নিয়ে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে দেন ল্যাব টেকনিশিয়ানরা। শুধু তা–ই নয়, নমুনা পরীক্ষার পর ল্যাব থেকে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে, তাতে ছিল না চিকিৎসকের কোনো স্বাক্ষর।

পরীক্ষার জন্য রোগীদের যাতে দ্বারে দ্বারে দৌড়াতে না হয়, সে জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু আছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা অকার্যকর রেখে প্যাথলজি পরীক্ষা নিয়ে এভাবে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে আসছে ল্যাব-সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে রোগীর স্বজন রনি বলেন, ‘হাসপাতালে যে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু আছে, সেটি দায়িত্বরত চিকিৎসক ও কর্মীরা রোগীদের বলছেন না। সরাসরি ওয়ার্ড থেকেই পাঠানো হয় প্যাথলজি বিভাগে। কোনো ধরনের রসিদ ছাড়াই টাকা নেওয়া হয়। আবার রিপোর্টে টেকনিশিয়ানের অনুস্বাক্ষর থাকলেও নেই কোনো মেডিকেল অফিসারের স্বাক্ষর। এই রিপোর্ট কতটা গ্রহণযোগ্য, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।’

রোগীর শয্যা পেতেও টাকা দিতে হয়েছে জানিয়ে রনি বলেন, ‘রাত সাড়ে ৯টায় জরুরি বিভাগে আসার পর শুরুতেই বলা হলো শয্যা খালি নেই। পরে এক কর্মচারী বললেন ১ হাজার টাকা দিলে শয্যা পাবেন। পরে ৯০০ টাকা দিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটা শয্যা পেয়েছি।’

রসিদ ছাড়াই টাকা নেওয়ার তথ্য দিয়েছেন হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ভর্তি শিউলি বেগমের ছেলে আব্দুর রাকিবও। গত রোববার বিকেল ৪টার দিকে রক্তের কণিকা, হিমোগ্লোবিনসহ কয়েকটি পরীক্ষার জন্য প্যাথলজি বিভাগের ১১০ নম্বর কক্ষে নমুনা পাঠানো হয়। সেখানে টাকা নিল, কিন্তু দেয়নি কোনো রসিদ।

শুধু এই দুই রোগী নন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বিকেল ও রাতের শিফটে প্যাথলজি পরীক্ষা

করাতে আসা অধিকাংশ রোগীর কাছ থেকে দিনের পর দিন এভাবেই রসিদ ছাড়াই টাকা নিচ্ছেন টেকনিশিয়ানরা।

অভিযোগ রয়েছে, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সকালের শিফটে ওয়ান স্টপ সার্ভিসে রসিদের মাধ্যমে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও বিকেলের শিফটে বিশেষ করে ভর্তি রোগীদের পরীক্ষায় এমন অনিয়ম চলে আসছে বছরের পর বছর। এই শিফটে দৈনিক গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন রোগীর ভর্তি পরীক্ষা হয়ে থাকে, কিন্তু টাকা ঢোকে ল্যাব টেকনিশিয়ানদের পকেটে। টানা তিন দিন হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

গত রোববার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে হিমোগ্লোবিন, ডব্লিউবিসি, আরবিসি, প্লাটিলেটসহ মোট পাঁচটি পরীক্ষা করতে প্যাথলজি বিভাগে যান এই প্রতিবেদক। পরীক্ষার স্লিপ দেওয়ামাত্রই রক্ত নেন একজন টেকনিশিয়ান। জানানো হয়, মোট খরচ ৮৫০ টাকা। রিপোর্ট মিলবে এক ঘণ্টার মধ্যে। ওই দিন ৫০০ টাকা দিয়ে মঙ্গলবার বাকি ৩৫০ টাকা দিলে একটি কক্ষে নিয়ে রিপোর্ট দেন

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর নামে একজন টেকনিশিয়ান। রিপোর্ট হাতে পেলে বরাবরের মতোই দেখা যায়, ল্যাবরেটরির কর্তব্যরত কর্মকর্তার কোনো স্বাক্ষর নেই।

স্বাক্ষর ছাড়া রিপোর্ট কতটা সঠিক জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরের বক্তব্য, ‘এটা কোনো সমস্যা না। আমরাই পরীক্ষা করি, এভাবে হাজার হাজার রিপোর্ট করি। কখনো কখনো ডাক্তারদের স্বাক্ষরও আমরা নিজেরাই দিই।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন টেকনিশিয়ান জানান, বিকেলের শিফটের যত পরীক্ষা হয়, প্রায় সব এভাবেই চলে। তার মুখে জানা যায়, কতিপয় চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে দিনের পর দিন এসব অনিয়ম চলছে। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা প্যাথলজি বিভাগের ল্যাবরেটরি ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম।

অনেক চেষ্টা করেও এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান প্যাথলজি বিভাগের একজন চিকিৎসক। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, এসব ঘটনায় অনেকেই জড়িত। পরিচালকও বিষয়টি জানেন। বিকেলের শিফটে অন্তত ৪০ হাজার টাকার মতো পরীক্ষা হয়। এখানে বেশির ভাগই জরুরি বিভাগের রোগীরা আসে। এখন তো তা-ও পরীক্ষা করা হচ্ছে, দু-তিন বছর আগে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই রিপোর্ট দেওয়ার নজির ছিল অহরহ। ২০১৯ সালে যখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি ছিল, সেই সময় একেকজন টেকনিশিয়ান রসিদ ছাড়া পরীক্ষা করে এক রাতেই লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কিন্তু আবারও সেটি চালু হয়ে গেছে। এখানে আয়া থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এই অবস্থা।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান এমন অনিয়মের বিষয়ে তিনি জানতেন না বলে দাবি করেন। অভিযোগ দেওয়ার পর তিনি টেকনিশিয়ান জাহাঙ্গীর ও ল্যাব ইনচার্জ জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজনকে তলব করেন। এ সময় অভিযুক্ত টেকনিশিয়ান জাহাঙ্গীর নিজেই বিষয়টি স্বীকার করেন। দায় নেন ইনচার্জও।

এ সময় পরিচালক খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমি ভাবতেও পারিনি এমনটা হচ্ছে। এখন দেখি ঘটনা সত্য। অথচ এটা যাতে না হয়, তাই ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছি। তার পরও দিনের পর দিন এমনটা চলছে। এই অনিয়মের দায় ইনচার্জসহ বিভাগের সবাইকে নিতে হবে। তারা চাইলেও এর দায় এড়াতে পারেন না।’

এ ঘটনায় উপপরিচালক ডা. মো. সাইদুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান হাসপাতালের পরিচালক। বলেন, সাত দিনের মধ্যে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া যত দ্রুত সম্ভব সব ধরনের লেনদেন অটোমোশনে যাতে হয়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘দিনের পর দিন যদি এভাবে চলে আসে, তাহলে পরিচালকের কাজ কী? কেন তিনি ব্যবস্থা নিলেন না? যেহেতু তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, দেখা যাক কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

আমাদের বাণী/১৮/৬/২০২২/বিকম

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.