
ঢাকাঃ দেশে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত মাদক, নারী ও শিশু নির্যাতন-ধর্ষণ, সাইবার অপরাধ- এই তিন ধরনের মামলায় দুর্বল চার্জশীট দেয়ার কারণে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। সাইবার অপরাধে দায়ের হওয়া মামলার ৯৫ ভাগ আসামি অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছে। আর নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৯০ ভাগ আসামিই খালাস পেয়ে যায়। তদন্তকারী ও আসামি পক্ষের যোগসাজশে অধিকাংশ আসামি খালাস পেয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের তদবিরের চাপে অনেক সময়ে চার্জশীটে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। চার্জশীটে জালিয়াতি ধরা পড়লেও যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আদালতের রায়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হলেও প্রয়োজনীয় কার্যকরের পর্যাপ্ত নজির অনুপস্থিত। অনুসন্ধান, প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণে এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, দুর্বল চার্জশীট দেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আলামত জব্দে বিলম্ব। ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করা। অভিযোগপত্রে সাক্ষীর ঠিকানা নেই। সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধ ধারা লিপিবদ্ধে ভুল। এজাহারের সাক্ষীকে চার্জশীট থেকে বাদ দেয়া। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষী তালিকায় না রাখা। মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া। চার্জশীট প্রদানে তড়িঘড়ি। পুলিশি অভিযোগপত্রে এমন অসঙ্গতি ধরা পড়ছে। এছাড়া এজাহার ও অভিযোপত্র গরমিলের ঘটনাও বারবার আলোচনায় আসছে। অভিযোগপত্র বদলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবুও চার্জশীট গাফিলতি কমছে না। বাড়ছে না সতর্কতাও। ফলে ভুলে ভরা ও দুর্বল অভিযোগপত্র দায়ের করা হচ্ছে আদালতে। এতে খালাস পাচ্ছে দাগি আসামিরা। অনেক মামলায় পারিপার্শ্বিক সাক্ষী ও আসামিদের স্বীকারোক্তিই ভরসা থাকা সত্ত্বেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সাক্ষীদের। আবার দুর্বল তদন্তে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। এতে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। বিভিন্ন সময়ে চার্জশীটে গরমিলে ভর্ৎসনা করেন আদালত। তবুও সমাধান মেলেনি। অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপেও চার্জশীটের প্রকৃত সত্য আড়াল হয়ে যায়। বাদ পড়ে যায় প্রকৃত অপরাধীরা। তবে আদালতে চার্জশীট জালিয়াতি ধরার পরও তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয় না। এ বিষয়ে নেই কোন জবাবদিহিতাও।
উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতের একটি মামলা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি মামলার রায়ে মাদকসহ গ্রেফতার আসামিকে খালাস দেন পিরোজপুরের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি। তাকে নিরপেক্ষ সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও রাষ্ট্রপক্ষ সব সাক্ষী হাজির না করায় আসামিপক্ষ সুবিধা পেয়েছে। আসামিকে হাতেনাতে মাদকসহ আটকের বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধিকাংশ মামলার রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণ দেন। অনেক সময় আদালতের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ্যে আসে না। তাই অজানাই থেকে যায় চার্জশীট অসঙ্গতির বিষয়গুলো। পর্যবেক্ষণে আদালত তদন্তের নানা দুর্বলতার কথা তুলে ধরেন। গ্রহণযোগ্য সাক্ষী হাজির করতে না করার কথা বলেন। মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতির কথাও পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। কিন্তু এসব বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে আবারও একই দুর্বলতাসহ মামলা ও তদন্ত করায় আসামি খালাসের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু বিচারিক আদালত নয় তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি, তদন্তে ত্রুটি, দুর্বল সাক্ষ্যের কারণে উচ্চ আদালতেও আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। অনেক মামলার রায়ে আদালত তদন্তের দুর্বলতাসহ নানা পর্যবেক্ষণ দেন। পর্যবেক্ষণগুলো আমলে না নেয়ায় আসামি খালাস বাড়ছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
রাজধানী ঢাকার রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায় সব আসামি খালাস ও একজন এমপির ছেলেকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার পরে পুলিশের চার্জশীট গাফিলতির বিষয়টি আলোচনায় আসে। সমালোচনা হয় দেশব্যাপী।
এমপির ছেলের মামলা র্যাবের অভিযোগপত্রে অস্ত্র ও মাদক জব্দ করলেও আদালতে দাখিল করা পুলিশ
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে এমপির ছেলের বাসা থেকে কোন আলামত জব্দ করা হয়নি। শুধু রেইনট্রি হোটেল ও এমপির ছেলের মামলায়ই নয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘দায়সারা গোছের’ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।
আইনজীবীরা বলছেন, অনেক সময় আলোচিত ঘটনায় আসামি খালাস পেলে প্রশ্ন ওঠে, কী কারণে তারা খালাস পেল। অন্য ক্ষেত্রে আসামি খালাসের ঘটনা অগোচরেই থেকে যায়। তারা বলছেন, একটি বিচার প্রক্রিয়া মূলত সুঁই-সুতা দিয়ে বুননের মতো। একটু একটু করে সেটি যৌক্তিক পরিণতি পায়। যে কোন একটা জায়গায় ছেদ পড়লে সেটি সঠিক পরিচালিত হবে না। প্রাথমিকভাবে তিনটি স্তরে দেখা যায়, যেখানে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গত ২০ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিদফতরের দায়ের করা মামলার মধ্যে ২৩ হাজার ৫৩৫ মামলায় প্রায় সব আসামি খালাস পেয়ে গেছেন। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ২৬ হাজার ১৩৮। এই আসামিরা মাদকসহ হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন বলে মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল। কিন্তু এজাহার ও তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষী হাজির করায় ব্যর্থতাসহ নানা কারণে এসব আসামির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। ফলে আদালত এই বিপুলসংখ্যক মামলায় আসামিদের খালাস দেন। এসব মামলার অধিকাংশ তদন্তও করেছে অধিদফতর। পুলিশও কিছু মামলা তদন্ত করেছে। এদিকে খালাসের কারণ হিসেবে সব পক্ষই বলছে, ত্রুটিপূর্ণ এজাহার ও অভিযোগপত্র, বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপন করতে না পারা এবং জব্দতালিকা সঠিকভাবে না করায় আসামিরা সুবিধা পেয়েছেন। জব্দতালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, বাদী ও অভিযানকারীদের বক্তব্যে অমিল থাকার কারণেও অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি। আবার অনেক কর্মকর্তা মাদক উদ্ধারে মনোযোগী হলেও তদন্তে কম আগ্রহ দেখিয়েছেন। ফলে আদালতে দায়সারা অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
আসামি খালাসের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সাইবার অপরাধের মামলাগুলো। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন-ধর্ষণের মামলা। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলাগুলো। ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ট্রাইব্যুনালে ৭৭০টি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩০টিতেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। আদালত প্রতিবেদন গ্রহণ করে বেশির ভাগ আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছেন। এছাড়া ১০৮টি মামলার অভিযোগ গঠনের আগেই আদালত আসামিদের অব্যাহতি দিয়েছেন। মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া আসামি ৬৮ দশমিক ৮৮ ভাগ। সাজা হয়েছে মাত্র ২৫টি মামলায়। এদিকে বিচারপ্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় ১১০টি মামলার আসামিদের বেকসুর খালাস দেন আদালত। সব মিলিয়ে সাইবার অপরাধে হওয়া ৯৫ ভাগ মামলায় আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৬০ জন। পুলিশ প্রতিবেদনের পরই অনেক মামলা থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন। যাচাই-বাছাই ছাড়া থানায় মামলা নেয়া, আদালতে সাক্ষ্য উপস্থাপন না করা, তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে আইটি রিপোর্ট দাখিল না করা, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও মামলার তথ্যগত কাগজপত্র সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করে গোঁজামিল অভিযোগপত্র দেয়ার কারণেই আসামিরা খালাস পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন আইনজ্ঞরা।
আইসিটি মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফরেনসিক রিপোর্ট, ইলেকট্রনিক ডিভাইস, প্রকাশিত বিষয়ের ইউআরএল ও ঘটনার আলামত। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা অধিকাংশ সময় এগুলো বাদ দিয়ে দায়সারা অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করেন। এতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের (অভিযোগ গঠন) কোন উপাদানই খুঁজে পান না ট্রাইব্যুনাল। উপাদান খুঁজে না পাওয়ায় তাদের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। একই অবস্থা নারী ও শিশুধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনার মামলাগুলোর। এসব ঘটনায় মামলা হলেও আইনী ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে বেশির ভাগ অভিযুক্তই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। আইন সালিশ কেন্দ্র আসকের পরিসংখ্যান বলছে, নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৯০ ভাগ আসামিই খালাস পেয়ে যায়।
আইনজীবী, ফরেনসিক বিভাগের কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, থানা, শারীরিক পরীক্ষা ও সাক্ষী উধাও এই তিন ধাপের গরমিলের মধ্য দিয়ে ধর্ষণ মামলা দুর্বল করা হয়। সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে সাক্ষীদের পিছিয়ে পড়ার প্রবণতাও রয়েছে। মূলত এসব কারণে ধর্ষণের মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলেই বাংলাদেশে এক হাজারে মাত্র চারজন আসামি ধর্ষণ মামলায় সাজা পায় না।
সাইবার মামলার বিষয়ে মতামত দিয়ে সুপ্রীমকোর্টের একজন আইনজীবী বলেন, ‘আইসিটি আইনের মামলাসমূহ তদন্তে কর্মকর্তাদের দুর্বলতা রয়েছে। এ বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তাহলে চার্জশীট দেয়ার পর আসামিদের অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
মাদক মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী বলেছেন, এজাহারে ত্রুটি থাকলে, সঠিকভাবে জব্দতালিকা না হলে আসামিরা সুযোগ পেয়ে যান। তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি এবং বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপন না কারণেও অনেক মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
মানবাধিকার সংগঠন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ একাধিক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞগণের সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন বিশেষ করে ধর্ষণ মামলা পরিচালনার জন্য সঠিক তদন্ত সঠিক প্রসিকিউশনসহ অন্যান্য উপকরণ দরকার। রেইনট্রি হোটেলের ঘটনায় দায়ের মামলায় সে বিষয়গুলো ছিল কি-না, তা পর্যালোচনা করা জরুরী। পাশাপাশি যে নারী ও তরুণীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তাদের জন্য যথার্থ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি-না, সেগুলোও দেখতে হবে। অভিযোগ করা হচ্ছিল, পুলিশ ওই মামলা সময়মতো নেয়নি এবং ঘটনাও সঠিকভাবে তদন্ত করেনি। যে পুলিশ সদস্য সঠিক সময়ে মামলা নেননি, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার, যা প্রায়শ: তার প্রতিফলন দেখা যায় না- এটা খুবই দুঃখজনক। সূত্র; জনকন্ঠ
আমাদের বাণী/৩০/৫/২০২২/বিকম
Leave a Reply