পাচারে কমিশন পায় রোহিঙ্গা নারীরা

কক্সবাজারঃ কমিশনের ভিত্তিতে ইয়াবা ও মানবপাচার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নারীদের। অস্ত্র চালানো প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে ইন্টারনেট ব্যবহার, বিদেশে তথ্য আদান-প্রদান ও ক্যাম্পের বিভিন্ন গোপনীয়তা ফাঁস ইত্যাদি অপরাধ করছে রোহিঙ্গা মহিলারা। এছাড়াও রাষ্ট্রদ্রোহী নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে ২ শতাধিক নারী। এসব কাজে তাদের সহযোগিতা দিচ্ছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পে বড় ধরনের অপরাধমূলক মিশন চালানোর আগে সন্ত্রাসীরা তাদের সহযোগী নারীদের ব্যবহার করে চলেছে।

জানা যায়, উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে কারাতে ও অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২ শতাধিক নারী রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ কম্পিউটার-ল্যাপটপ পরিচালনায়ও দক্ষ। এসব মহিলা কেউ বিবাহিতা, কেউ স্বামী পরিত্যক্তা। তারা সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের স্ত্রী ও আত্মীয়। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে একাধিক কারণে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে-প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হামলায় স্বামী-ভাই (সন্ত্রাসী) অস্ত্র চালনায় কোন কারণে অক্ষম হয়ে পড়লে যেন ওই মহিলারাই অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে- ক্যাম্পে কারা মাদক কারবার ও দোকানপাট করে টাকা গচ্ছিত রেখেছে, কাদের কাছে অস্ত্র রয়েছে, মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ কারা তার খোঁজ-খবর নেয়া। বিদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা নেতাদের কাছে ইন্টারনেটে গোপন তথ্য পাচার করা। টেকনাফের লেদা, জাদিমুড়া, মৌচনী, নয়াপাড়া ও শালবাগান, উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের পাহাড়ি আস্তানায় অবস্থান নিয়ে একাধিক সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আর্মড পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওইসব সন্ত্রাসীদের ধরতে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তবে কেউ ওই সন্ত্রাসীদের বিষয়ে তথ্য না দেয়ায় প্রশাসনের লোকজন অভিযানে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। অভিযানে যাবার আগে তাদের গ্রুপের লোকজন মুঠোফোনে জানিয়ে দেয় সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের। প্রশাসনের লোকজন অভিযানে যাবার আগে খবর পৌঁছে দেয়ার কাজে রোহিঙ্গা পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর পূর্বে সটকে পড়ে সশস্ত্র রোহিঙ্গা ক্যাডাররা। তারপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বহু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী-ডাকাত নিহত ও আটক হয়েছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেন, রোহিঙ্গাদের অপকর্মের কোন শেষ নেই। হত্যা থেকে শুরু করে টাকার বিনিময়ে এমন কোন কাজ নেই, যা রোহিঙ্গারা করতে পারে না। তাদের কারণে নষ্ট হচ্ছে এলাকার পরিবেশ প্রতিবেশ। ইয়াবা ও মানবপাচারে রোহিঙ্গা নারীদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। মানবপাচার কাজে জড়িত দালালরা কমিশনভিত্তিক রোহিঙ্গা নারীদেরই নিরাপদ মনে করছে। দালালদের ধারণা-পুরুষের চাইতে রোহিঙ্গা নারীরা ক্যাম্পে বিচরণ করতে পারে অনায়াসে। পুরুষ নয়, মহিলারা রোহিঙ্গা নারীর কাছে পৌঁছতে পারছে সহজে। কোথায় গেলে এবং কিভাবে কথা বললে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া যেতে রাজি করানো যাবে-তা পুরুষ দালালরা আগেই সহজে বুঝিয়ে দেয়। সাগর পথে ও বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গাদের ইয়াবার চালান জব্দ ও মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট আটকও হচ্ছে। তবুও মালয়েশিয়া যাত্রা এবং ইয়াবা কারবার ছাড়ছে না বহু রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। শুধু ইয়াবা এবং মানবপাচার নয় ছিনতাইয়ের মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে রোহিঙ্গা নারীরা। শামলাপুর ২৩নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুলতান, জন্নাত আরা, ফাতেমা তিনজন ভাইবোন। ফাতেমা হ্নীলা মোছনী ক্যাম্পে আশ্রয় নিলেও জন্নাত আরা এবং সুলতান শামলাপুর হোয়াইক্যং ঢালার মুখ এলাকায় বসবাস করে ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে বহু ধনসম্পদের মালিক বনেছে। সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঢাকা থেকে নারী পর্যটকের মোবাইল ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে মরিয়ম নামে এক রোহিঙ্গা নারী ছিনতাইকারী। বিভিন্ন কৌশলে ছিনতাই করত রোহিঙ্গা নারী মরিয়ম। পরে জেলা প্রশাসনের বিচ কর্মীদের হাতে আটক ও পরে বিচ কর্মীরা তাকে থানায় সোপর্দ করে।

সূত্রে জানা যায়, দুই শতাধিক নারী বিভিন্ন অপরাধ কর্মকা-ে সক্রিয়। মাদক বহনকারী হিসেবে রোহিঙ্গা নারীদের ব্যবহার থেমে নেই। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার কিংবা যে কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। তারা ক্যাম্পে অস্ত্রের মহড়া এবং ফাঁকা গুলি ছুড়ে নিজেদের শক্তি সম্পর্কে জানান দেয়। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- নাবী হোসেন গ্রুপ, হাকিম বাহিনী, নুর আলম বাহিনী, মাস্টার মুন্না বাহিনী, হাফেজ জাবের বাহিনী, আনাস বাহিনী, ইসলাম মাহমুদ বাহিনী, মাস্টার আবুল কালাম গ্রুপ। এসব অপরাধে রোহিঙ্গা নারীদের ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পে কমপক্ষে ২০টি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী গ্রুপ অপতৎপরতায় জড়িত।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ রয়েছে। আমাদের চেষ্টা থাকে যাতে কোনও অপরাধ কর্মকাণ্ড না ঘটে। ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে এবং অপরাধীদের কঠোরভাবে দমন করা হবে বলেও জানান তিনি। ২০১৭ সালের ২৩ নবেম্বর নেপিডোতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে চুক্তি হয়। সাড়ে চার বছরেও চুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলা, নিপীড়ন ও হত্যার কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এছাড়াও এর আগে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা। বর্তমানে তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ১৩ লাখ। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ক্যাম্প নির্মাণ করে তাদের আশ্রয় দিলেও তাদের ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও নিজ দেশে ফিরে যাবার তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

আমাদের বাণী/২৯/৫/২০২২/বিকম

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.