কোথায় যায় পাচারের টাকা

ঢাকাঃ টাকা পাচার সূচকের মানদণ্ডে ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠছে বাংলাদেশ। দেশের টাকা বিভিন্ন উপায়ে অন্য দেশে পাঠিয়ে সে দেশের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের আর্থিক খাত পিছিয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার গন্তব্য মূলত ১১টি দেশ। এসব দেশে গত ৬ বছরে ৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়েছে বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে মতে, বিশ্বের ৩টি দেশে পাচার হওয়া টাকার বড় অংশ যায়। এর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কানাডা। আরও ৮টি দেশে বেশি পরিমাণে টাকা পাচার হয়। যেসব দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নেই, দুর্নীতি কম, করহার কম এবং কঠোর আইন পালন করা হয় সেসব দেশেই মূলত টাকা যায়।

টাকা পাচারকারীদের প্রিয় গন্তব্য এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর। দেশটি এশিয়ার টাইগার বলেও বিবেচিত হয় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির জন্য। দেশটিতে বিশ্বের প্রায় সব বড় প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর সরকার ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের কর ছাড়সহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। এ কারণে দেশটি টাকা পাচারের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার ৩৩ শতাংশ এই একটি দেশেই যায় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। দেশের একটি বড় শিল্প গ্রুপ সিঙ্গাপুরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে কিনেছে দুটি হোটেল।

টাকা পাচারের জন্য এরপরের গন্তব্যটি এশিয়ার অপর দেশ মালয়েশিয়া। এদেশে সেকেন্ড হোম সুবিধা পাওয়া যায় একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিয়োগে। সেই সুযোগটিই নেয় টাকা পাচারকারীরা। এ ছাড়া মালয়েশিয়া তার দেশে বিনিয়োগ হওয়া টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে না। পাশাপাশি বিনিয়োগ করা টাকার নিরাপত্তা দেয় আইনের মাধ্যমে। তাই এ দেশে টাকা পাচার করা নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের বলে টাকা পাচারকারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ দেশে যায় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। এ দেশে পাচার হওয়া টাকার ১৭ শতাংশ অবদান রয়েছে বলে জানা যায়।

পাচারকারীদের এরপরের প্রিয় গন্তব্য উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা। এ দেশে পাচার করা টাকার প্রায় ১৫ শতাংশ পায় বলে জানা যায়। দেশটিতে বেগমপাড়া নামে আলাদা একটি এলাকা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশিদের কেনা বাড়ি এবং সম্পদের জন্য বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বেগমপাড়ায় সরকারি কর্মকর্তা এবং বড় ব্যবসায়ীদের দামি বাড়ি ও সম্পত্তি রয়েছে।

এর আগে গত বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজনীতিবিদদের চেয়েও সরকারি আমলা ও ব্যবসায়ীদের বাড়ি বেশি বেগমপাড়ায়। নাটোরের এক এমপি ১২ কোটি টাকা খরচ করে বিলাসবহুল একটি বাড়ি কিনেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এ ছাড়া ফরিদপুরের আওয়ামী লীগের দুই সহোদরের ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

টাকা পাচারের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় সুইস ব্যাংকের নাম। অথচ সুইজারল্যান্ডের এ ব্যাংকে পাচার করা টাকার মাত্র ৫ শতাংশ জমা হয়। এর চেয়ে বেশি অর্থ যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও কাতারে। এসব দেশ ছাড়াও নতুন গন্তব্য হিসেবে মিসর, গ্রিস, জার্মানি ও ব্রাজিলের নাম আসছে সামনে। দক্ষিণ আফ্রিকাও এ তালিকায় রয়েছে বলে জানা যায়।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাচার করা টাকার যথাক্রমে ৪ ও ৩ শতাংশ পায় বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন সিআইডির এক কর্মকর্তা। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, বিদেশে যারা টাকা পাচার করে তারা সবাই প্রভাবশালী। এদের বিরুদ্ধে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কথা বলা খুবই কঠিন। তাই সহজেই এদের নাম নেওয়া যায় না। তাদের বিরুদ্ধে খোঁজখবর করতে গেলেও তারা জেনে যান। প্রভাব খাটিয়ে তদন্ত থামানোর চেষ্টা করেন, তদন্তকাজ ব্যাহত করেন। এ কারণে চাইলেও দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া যায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতি বছরই টাকা পাচার হচ্ছে। অথচ এ দেশে টাকাগুলো থাকলে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগত। মূলত সরকারি দলের অনেকে কিংবা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যারা সরকারি দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তারাই বেশি টাকা পাচার করেন।’

কী পরিমাণ টাকা পাচার হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটার সঠিকত কোনো তথ্য কেউ দিতে পারবে না। কারণ যেসব দেশে টাকা যায় সেসব দেশ এ বিষয়ে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করে। কোনো তথ্য লিক হতে দেয় না। এসব বিষয় নিরাপদ বলেই দেশগুলোয় টাকা পাচার করা হয়। নইলে এত টাকা পাচার হতো না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পেপারে কারও কারও নাম আসে বিচ্ছিন্নভাবে। বিভিন্ন অনুসন্ধানী দলও তথ্য প্রকাশ করে। তবে সেগুলোর কোনোটিই একেবারে সঠিক না। তবুও আনুমানিক হিসাবে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। আমেরিকার গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফই) একটি প্রতিবেদনে দেখায়, প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে গত ৬ বছরে।’

টাকা পাচারের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থপাচারের ইস্যুটি অনেক পুরনো। বিভিন্ন সংস্থা থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, যে কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। অনেকেই এ দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করেন না। ফলে টাকা বাইরে নিয়ে যান। করোনার কারণে দুই বছর টাকা পাচার বন্ধ ছিল। কিন্তু এ বছর তা আবার বেড়েছে। যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ একবার বিদেশে টাকা গেলে, তা ফেরত আনা খুব কঠিন। সরকার তার ভাবমূর্তি হারানোর ভয়ে তথ্য লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এগুলো করে লাভ হয় না। কারণ ভাবমূর্তি শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয় না।’

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টাকা পাচার হয় মূলত ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। টাকা পাচারের বিরুদ্ধে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। পাচার বন্ধ করতে যথাযথ আইনপ্রয়োগের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। এটি একটি সফিস্টিকেটেড কাজ। টাকা পাচার বন্ধ করতে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ডে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বাইরে পাঠানো টাকা আবার দেশে ফেরত আসবে। এমন সুবিধা দেব যে তারা দেশের টাকা আবার দেশে ফেরত আনবে। সূত্র; সময়ের আলো

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.