ডাকাতি-ছিনতাইয়ের অভয়ারণ্য মহাসড়ক

মহাসড়ক

ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের অভয়ারণ্যে যেন পরিণত হয়েছে হাইওয়ে বা মহাসড়কগুলো। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় পুরো অংশই বর্তমানে পরিণত হয়েছে ডাকাতির ডেঞ্জার জোনে। বিভিন্ন পণ্যবাহী ট্রাক, লরি ও কাভার্ড ভ্যানকে প্রধানত টার্গেট করে ডাকাতি করা হচ্ছে।

যানজটপূর্ণ এলাকায় গাড়ির ধীরগতি কিংবা কোনো কারণে সড়কের পাশে গাড়ি দাঁড় করালেই হানা দিচ্ছে ডাকাত বা ছিনতাইকারী চক্র। অনেক ক্ষেত্রেই ডাকাতরা নির্বিঘ্নে অপকর্ম চালাতে ব্যবহার করছে পুলিশের নকল পোশাক। আর এসব ডাকাতের হামলায় প্রায়ই হতাহতের শিকার হচ্ছে বিভিন্ন যানবাহনের চালক-যাত্রীরা। এ কারণে প্রাণ হাতে নিয়ে মহাসড়কে চলাচল করছে লাখ লাখ চালক-যাত্রী।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু মহাসড়কের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য হাইওয়ে পুলিশ ইউনিট গঠন করা হলেও অপরাধপ্রবণতা সেভাবে কমছে না। বরং কোথাও কোথাও এসব ভয়ঙ্কর অপরাধ আরও বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও হরহামেশা চালকদের হয়রানি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের মারুয়াদী বাজার এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে একটি ডাকাত চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন। এ ছাড়াও আন্তঃজেলা ডাকাত দলের দুর্ধর্ষ একটি চক্রের কয়েক সদস্য বর্তমানে গোয়েন্দাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছে বলে বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে। যেকোনো সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলের দুর্ধর্ষ ওই ডাকাত চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হতে পারে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতি-ছিনতাইসহ মাদক কারবার করা এই চক্রের অন্যতম হোতার নাম বাদল ওরফে বাদল ডাকাত। তার বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়ায়। বাদল ছাড়াও কোরবান ডাকাত ও সুমনসহ আরও কয়েকজনের নির্দেশনা বা নেতৃত্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ডাকাতির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া ও অপারেশন) মো. শামসুল আলম  বলেন, গত তিন-চার মাসের মধ্যে মহাসড়কে কোনো ডাকাতি-ছিনতাইয়ের খবর নেই। এমন কিছু ঘটলে আমরা জানতাম। বর্তমানে মহাসড়কের পরিস্থিতি ভালোই আছে।

তবে নারায়ণগঞ্জের র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মোহাম্মদ পাশা বলেছেন, ঈদের আগে ও পরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপটে র‌্যাব মাঠে কাজ করতে গিয়ে দেখেছে, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁকেন্দ্রিক একটি ডাকাত চক্র বেশ তৎপরতা চালিয়ে থাকে। এই চক্রটি আড়াইহাজার এলাকার দিকেও ডাকাতি করে থাকে। ইতোমধ্যেই গত বৃহস্পতিবার রাতে আড়াইহাজার এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে র‌্যাব-১১-এর একটি দল ৯ সক্রিয় ডাকাতকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।

তানভীর মোহাম্মদ পাশা আরও বলেন, কুমিল্লার চান্দিনা এলাকায়ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ধর্ষ ডাকাত চক্রের তৎপরতার খবর রয়েছে। এই চক্রের সদস্যরা সাধারণত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না। অস্ত্র হিসেবে তারা ধারালো চাপাতি, কিরিচ, ছোরা ও রামদা ব্যবহার করে থাকে। মহাসড়কে কোনো কারণে কোনো গাড়ি থামলে বা যানজটে পড়লে সে সুযোগ কাজে লাগায় এ ডাকাত চক্র। এ ছাড়া গাছের ডালপালা ফেলে বা গাড়ির কাচে ইট-পাথর নিক্ষেপ করেও গতিরোধের চেষ্টা করে থাকে।

বাংলাদেশ ট্রাক চালক-শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি তালুকদার মো. মনির বলেন, মহাসড়কে চাঁদাবাজি-ডাকাতিতে অতিষ্ঠ হয়ে আমরাই হাইওয়ে পুলিশ গঠনের জন্য আন্দোলন পর্যন্ত করেছি। অথচ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং প্রাণ হাতে নিয়ে আমাদের চালকরা সড়কে গাড়ি চালান। অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছেন। মহাসড়ক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মহাসড়কের ৩০-৩৫টি জায়গায় প্রায়ই ডাকাতি হচ্ছে। এর মধ্যে আছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছাড়াও ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-ফরিদপুর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায়ই ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, সোনারগাঁ, কাঁচপুর, কুমিল্লার চান্দিনা, পদুয়া, ফেনীর বড়কুণ্ড, সোয়াগাজী, সীতাকুণ্ড এলাকায় ডাকাত চক্রের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, নরসিংদী ও মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর (ন্যাশনাল পার্ক), ভালুকা, আশুলিয়া, এলেঙ্গা, চম্পাগঞ্জ, মির্জাপুর, কালিয়াকৈর, কবিরপুর, বাইপাইল, নবীনগর, সাভার, হেমায়েতপুর, গেণ্ডা, চন্দ্রা, কোনাবাড়ী, ধামরাই ও কামালপুরসহ আরও কিছু স্থানে ডাকাত-ছিনতাইকারীদের তৎপরতার খবর পাওয়া গেছে। এসব রুটে সাধারণত বিভিন্ন পণ্যবাহী লরি ও পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের কাভার্ড ভ্যান ও গরুর গাড়িগুলোকে বেশি টার্গেট করা হয়। এ ছাড়াও প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এমনকি যাত্রীবাহী বাসকেও অনেক সময় টার্গেট করে থাকে ডাকাত চক্রের সদস্যরা।

গত ১৯ মার্চ কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাইজখাঁর গ্রামের সৌদি প্রবাসী ফারুক হাওলাদার ১৩ বছর পর দেশে ফেরেন। ঢাকা থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ প্রাইভেটকারে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর কিউট পল্লীর সামনে ‘প্রকৃতির ডাকে’ সাড়া দিতে গাড়ি থামান। এ সময় ছয়-সাতজনের ডাকাত দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার বিদেশি মালপত্র ভর্তি স্যুটকেস, নগদ ১২ হাজার টাকা ও ১ হাজার ৪০০ সৌদি রিয়াল নিয়ে যায়। এর আগে গত ২১ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সোনাখালী এলাকার কফিল উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীকে সাত-আটজনের একটি দল সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে এসে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার ব্যাগে থাকা আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের গ্লোব অ্যাডিবল অয়েল লিমিটেড থেকে ৬০ ড্রাম (একেকটি ২০৪ লিটার) খোলা সয়াবিন তেল কিনে ট্রাকে করে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে নিজ প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় রাত পৌনে ১১টার দিকে নরসিংদীর শিবপুরের ইটাখোলা এলাকায় ডিবি পুলিশের জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় পাঁচ-ছয়জন একটি মাইক্রোবাস থেকে ট্রাক থামার সঙ্কেত দেয়। পুলিশ ভেবে চালক ট্রাক থামালে কাগজপত্র যাচাইয়ের নাম করে চালক ও সহকারীকে ট্রাক থেকে নামিয়ে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এরপর ট্রাকভর্তি তেল ডাকাতরা নিয়ে যায়।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁর মেঘনাঘাট থেকে ফ্রেশ সুগার মিল থেকে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে রাত পৌনে ২টার দিকে পাকুণ্ডা এলাকায় ট্রাকটির চালক আফজাল হোসেন ও হেল্পার সোহাগকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চিনিভর্তি ট্রাকটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়। গত ২৪ জানুয়ারি রাতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইস্পানির চর এলাকার তৌহিদুল ইসলাম তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ইউটার্নে পাঁচ-ছয় যুবক গতিরোধ করে ৫৭ হাজার টাকা, স্বর্ণের চেইন, আংটি ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এ ছাড়াও গত ২৮ মার্চ রাতে মো. জিহাদ নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। কাঁচপুর বিসিকের সামনে তার লাশ পাওয়া যায়। জিহাদের বিরুদ্ধে সোনারগাঁ থানায় ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে। পুলিশের ধারণা, ডাকাতির লুণ্ঠিত টাকা ভাগ-বাটোয়ারার দ্বন্দ্বে সে খুন হয়েছে।

জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার সময়ের আলোকে বলেন, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাস, ট্রাক ও প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহনে ডাকাতির শিকার হয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ কল করেছেন ২৪৮ জন। দৈনিক প্রায় তিনটি কলের ঘটনা ঘটছে। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডাকাতের কবলে পড়ে পুলিশের তাৎক্ষণিক সহায়তা চাওয়া কলের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩৩টি।

ডাকাতির প্রস্তুতিকালে আড়াইহাজারে গ্রেফতার ৯ : নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকা থেকে দেশীয় অস্ত্র ও ককটেলসহ ডাকাত দলের ৯ সক্রিয় সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব-১১। বৃহস্পতিবার রাতে তাদের আটক করা হয়। তারা হলো- সবুজ, সাখাওয়াত হোসেন রনি, সোহেল ওরফে ইসমাইল, আবুল কাশেম, মিজান, ওমর ফারুক, সোহেল, মোহাম্মদ রবিউল শেখ, জাহাঙ্গীর সিকদার। এ সময় ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত সাতটি ককটেল, দুটি রামদা, ১৬টি ছোরা, দুটি শাবল, একটি চাইনিজ কুড়াল, একটি তলা কাটার, দুটি তরবারি, পাঁচটি টেঁটা ও ১০টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক তানভীর মাহমুদ পাশা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই ডাকাত চক্র গত ৬ এবং ২৪ এপ্রিল আড়াইহাজার থানা এলাকায় সংঘটিত ডাকাতির ঘটনায় জড়িত ছিল। আটকদের বিরুদ্ধে আড়াইহাজার ও সোনারগাঁ থানায় একাধিক ডাকাতি ও মাদক মামলা রয়েছে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.